'আমি হলে বিমানবন্দর থেকেই ফেরত যেতাম'

রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে গতকালের সেমিনারে বক্তব্য দেন অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ l প্রথম আলো
রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে গতকালের সেমিনারে বক্তব্য দেন অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ l প্রথম আলো

দেশের প্রধান বিমানবন্দর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে একটি বিপর্যয় হিসেবে অভিহিত করেছেন ব্যবসায়ীদের প্রভাবশালী সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর। তিনি বলেছেন, ‘আমি যদি বিদেশি বিনিয়োগকারী হতাম, তাহলে বিমানবন্দর থেকেই দেশে ফেরত যেতাম। বিমানবন্দরে নেমে আমাকে যদি ভিসা পেতে এক ঘণ্টার বেশি লাগত, ব্যাগ পেতে দুই ঘণ্টার বেশি লাগত, মশার কামড় খেতে হতো...এটা আমাদের দেশ সম্পর্কে ভালো পরিচয় নয়।’
রাজধানীতে গতকাল শনিবার ‘ব্যবসায় পরিবেশের উন্নয়ন: প্রধান নীতিগুলোর সংস্কার ও প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রাধিকার’ শীর্ষক এক সেমিনারে সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর এসব কথা বলেন। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) সোনারগাঁও হোটেলে এ সেমিনারের আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে নাসিম মঞ্জুর ছয়টি সুপারিশ তুলে ধরেন। এর মধ্যে পাঁচ নম্বরটি ছিল বিমানবন্দর-সংক্রান্ত। তিনি বলেন, ঢাকা বিমানবন্দরকে ঠিক করতেই হবে। তাঁর দেওয়া বাকি পাঁচ পরামর্শ হলো এ দেশে কর্মরত বিদেশি কোম্পানিগুলোর কয়েকটিকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর (দূত) হিসেবে ব্যবহার করা; কিছু নির্দিষ্ট দেশকে ঠিক করা, যেখান থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারী আনতে বাংলাদেশ আগ্রহী; বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন না করা; বিশ্বব্যাংকের লজিস্টিক পারফরম্যান্স ইনডেক্সে (পণ্য পরিবহন-সংক্রান্ত সূচক) উন্নতি করা এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ভিসা দেওয়ার ব্যবস্থা আরও সহজ করা।
ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে কয়েকটি কোম্পানির নামও উল্লেখ করেন নাসিম মঞ্জুর। এগুলো হলো ইউনিলিভার, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, কোটস বাংলাদেশ, ম্যারিকো ও মার্ক অ্যান্ড স্পেনসার।
বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন না করার বিষয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ করে নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যদি কর স্বর্গকে (ট্যাক্স হ্যাভেন) বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে, আমাদের জানতে চাওয়া উচিত হবে না যে অর্থের উৎস কী।’ এ সময় বিডার চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমি একমত।’
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিশ্বব্যাংকের ডুইং বিজনেস সূচকে বাংলাদেশ ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৭৬তম অবস্থানে আছে। বাংলাদেশের বিদেশি বিনিয়োগের স্থিতি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬ শতাংশ; যা দক্ষিণ এশিয়ার গড় হারের অর্ধেকের কম। যেসব দেশ ব্যবসায় পরিবেশের উন্নতি ঘটাতে পেরেছে, তারা বেশি বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ যত বেশি আসে, তত ভালো—এ ধারণা ঠিক নয়। যেসব ক্ষেত্রে দেশিরা ভালো করছে, সেখানে বিদেশি বিনিয়োগের দরকার নেই। আবার বাজার যদি সুরক্ষিত হয়, সেখানে দেশিদের সুযোগ দেওয়া উচিত।
এমসিসিআইয়ের সভাপতি নিহাদ কবির একটি কোম্পানির যন্ত্রপাতি আমদানির ঘটনা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে বলেন, যন্ত্র আমদানিতে সরকার শুল্ক ছাড় দিয়েছে। কিন্তু তা পেতে নথিপত্র নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) আবেদন করতে হয়। প্রথমে ফাইলটি দ্বিতীয় সচিব, এরপর প্রথম সচিব, এরপর সদস্য, এরপর চেয়ারম্যানের কাছে যায়। চেয়ারম্যান অনুমোদন করার ফাইলটি আবার সদস্যের কাছে যায়। সদস্য ফাইলটি ট্যারিফ কমিশনের কাছে পাঠান। ট্যারিফ কমিশন সেটি নিয়ে একটি গণশুনানি করে। এরপর সেটি এনবিআর চেয়ারম্যানের সইয়ের জন্য পাঠানো হয়। এরপর ফাইলটি যায় অর্থমন্ত্রীর সইয়ের জন্য। সেখান থেকে আবার এনবিআরে আসে। এভাবে দীর্ঘ সময় চলে যায় উল্লেখ করে এমসিসিআই সভাপতি বলেন, ‘এ ধরনের ফাইলে কেন অর্থমন্ত্রীর স্বাক্ষর লাগবে?’
এ সময় অর্থমন্ত্রী বলেন, তিনি কখনো এ ধরনের ফাইল পাননি। জবাবে নিহাদ কবির বলেন, ‘কিন্তু এটাই তো প্রক্রিয়া। এ জন্যই আমরা বলছি সবকিছু সহজ করতে।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘১৫ থেকে ২০ বছর ধরে আমরা বিনিয়োগকারীদের ওয়ান স্টপ সার্ভিস (এক দরজায় সব সেবা) দেওয়ার ওয়াদা করেছি। কিন্তু কখনোই এখানে ওয়াট স্টপ সেবা ছিল না।’ তিনি উল্লেখ করেন, ওয়ান স্টপ সার্ভিস দেওয়ার বিষয়টি সরকারের উচ্চপর্যায়ের তদারকিতে আছে। এ নিয়ে বিডা কাজ করছে। অর্থমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের কিছু কিছু দাবি ও পরামর্শ লিখে নেন।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক আফতাব-উল ইসলাম, বিল্ডের প্রধান নির্বাহী ফেরদৌস আরা, বেজার সদস্য এমদাদুল হক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বাংলাদেশের প্রধান িনর্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আবরার এ আনোয়ার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।