এনআরবি কমার্শিয়ালের পর্ষদ ও এমডি ব্যর্থ

আমানতকারীদের স্বার্থে ও জনস্বার্থে এনআরবি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংক চালাতে ব্যর্থ হয়েছে ফরাছত আলীর নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পর্ষদ। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দেওয়ান মুজিবর রহমান ব্যর্থ হয়েছেন ব্যাংকটিতে যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে। এমনকি তাঁরা গুরুতর প্রতারণা ও জালিয়াতি করেছেন, যা ফৌজদারি আইন অনুযায়ী দণ্ডনীয়।

এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিকে এসব কথা জানিয়ে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ধারা অনুযায়ী কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফরাছত আলীর বিরুদ্ধে কেন আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে না এবং দেওয়ান মুজিবর রহমানকে কেন অপসারণ করা হবে না—নোটিশে তা জানতে চাওয়া হয়েছে।

>ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬(২) ধারা অনুযায়ী অপসারণ করার আগে সংশ্লিষ্টদের কারণ দর্শাতে শেষ সুযোগ দেওয়া হয়েছে

ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমানতকারীদের জন্য ক্ষতিকর কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়লে বাংলাদেশ ব্যাংক তাঁকে অপসারণ করতে পারবে। ৪৬(২) ধারায় বলা হয়েছে, অপসারণ করার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে কারণ প্রদর্শনের জন্য যুক্তিসংগত সুযোগ দিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী গতকাল বুধবার এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, আইন অনুযায়ী এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। জবাব সন্তোষজনক না হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
যোগাযোগ করলে দেওয়ান মুজিবর রহমান এ বিষয়ে কথা বলবেন না বলে প্রথম আলোকে জানান।
পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিকে দেওয়া উভয় নোটিশে ১০টি কারণ তুলে ধরেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বলেছে, ব্যাংক পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম, বিধিবহির্ভূত ঋণ অনুমোদন ও বিতরণের সঙ্গে পরিচালনা পর্ষদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে, যা ব্যাংক কোম্পানি আইন ও আমানতকারীদের স্বার্থের পরিপন্থী।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘একজনের কারণে ঝুঁকিগ্রস্ত এনআরবিসি ব্যাংক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এনআরবিসি ব্যাংকে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চেয়ারম্যান শহীদুল আহসানের বহুমাত্রিক বেআইনি কর্মকাণ্ডের চিত্র তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নোটিশ অনুযায়ী ১০টি কারণের মধ্যে ৭টির সঙ্গেই শহীদুল আহসান জড়িত।
নোটিশ দুটিতে বলা হয়েছে, এনআরবিসি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য না হয়েও বহিরাগত মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক শহীদুল আহসান নিজে এবং তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট আহসান গ্রুপের (এজি) পরিচালক সৈয়দ গোলাম ফারুক এনআরবিসি ব্যাংকের পর্ষদ সভায় উপস্থিত থেকেছেন। এনআরবিসি ব্যাংকের বিদেশে থাকা পরিচালক এ বি এম আবদুল মান্নানের বিকল্প পরিচালক সৈয়দ গোলাম ফারুক, যিনি বিকল্প পরিচালক হওয়ার আগেই এনআরবিসি ব্যাংকের চারটি পর্ষদ সভায় উপস্থিত থাকেন।
আরও বলা হয়, কামরুন্নাহার সাখী, এ বি এম আবদুল মান্নান, ফিরোজ হায়দার খান, মো. আমির হোসেনসহ এনআরবিসি ব্যাংকের ১০ জন পরিচালকের বিপরীতে ১০ জন বিকল্প পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রেও বিআরপিডি সার্কুলার মানা হয়নি। আবার চারজন পরিচালক দেশে না এলেও স্বাক্ষর জাল করে পর্ষদ ও নির্বাহী কমিটির বৈঠকে তাঁদের উপস্থিত দেখানো হয় এবং জাল স্বাক্ষরের কার্যবিবরণীই এনআরবিসি ব্যাংক পাঠায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে, যা ফৌজদারি আইনে দণ্ডনীয়। এতে পরিচালকদের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়েছে এবং ব্যাংকের নেওয়া সিদ্ধান্ত প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, যা আমানতকারীদের অর্থকে ঝুঁকিগ্রস্ত করেছে।
অন্যদিকে এনআরবিসি ব্যাংকের বিকল্প পরিচালক সৈয়দ গোলাম ফারুক এজির উপদেষ্টা এবং কামরুন্নাহার সাখীর বিকল্প পরিচালক এ কে এম শফিকুল ইসলাম এজির পরিচালক। ব্যাংকিং নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে এ দুই বিকল্প পরিচালকের উপস্থিতিতেই শহীদুল আহসানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এজি এগ্রোর নামে ১১৯ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়।
এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডির উদ্দেশে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, প্রিন্সিপাল শাখার গ্রাহক শহীদুল আহসানের ২০১৩ সালের এক আবেদনের চার দিনের মাথায় মাত্র ৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা মূল্যের সহায়ক জামানতের বিপরীতে এজি এগ্রোর নামে ১৪০ কোটি টাকার ঋণসীমা মঞ্জুর করা হয়। এই ঋণের কিস্তি পরিশোধ হয় ব্যাংকের উত্তরা শাখার গ্রাহক আজিজ চৌধুরী ও তাঁর দুই ছেলে সালেহউদ্দিন চৌধুরী ও তারেক চৌধুরীর নামে নেওয়া গৃহনির্মাণ ঋণ এবং তাঁদের মালিকানাধীন স্টাইলিশ গার্মেন্টসের ঋণ হিসাব থেকে। বিআরপিডি সার্কুলার লঙ্ঘন করে ঋণের অর্থ উদ্দেশ্যবহিভূর্ত খাতে ব্যয় করা হয়।
নোটিশে বলা হয়, এজির স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বেগমগঞ্জ ফিড মিলের নামে ব্যাংকের নোয়াখালীর চন্দ্রগঞ্জ শাখা থেকে ঋণ দেওয়া হয় শাখার সুপারিশ ছাড়াই। পর্ষদ সদস্যরা আপত্তি করলেও এই ঋণ বিতরণ করা হয়।
চেয়ারম্যান ও এমডিকে এসব কথা বলার পাশাপাশি এমডির ব্যাপারে আরও কিছু প্রশ্ন তুলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বলেছে, কামরুন্নাহার সাখীসহ পরিচালকেরা দেশে না এলেও পর্ষদে তাঁদের উপস্থিত দেখানো হয় এমডির জ্ঞাতসারে ও যোগসাজশে এবং এমডি হয়েও তিনি বাংলাদেশ ব্যাংককে এসব তথ্য জানাননি। আবার কামরুন্নাহার সাখীর খেলাপি ঋণের তথ্যও গোপন রাখা হয়।