অর্থমন্ত্রীর পাশে আরও মন্ত্রী

বাজেট আলোচনায় এ দফায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের পাশে দাঁড়ালেন সরকারের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী ও অন্য সাংসদেরা। কেউ বলেছেন অর্থমন্ত্রী সফল, কেউ বলেছেন বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। অর্থমন্ত্রীর বিরোধিতাকারীদের সুবিধাভোগী-জ্ঞানপাপী বলেও আখ্যায়িত করেছেন কোনো কোনো সাংসদ।

জাতীয় সংসদে গতকাল বৃহস্পতিবার প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, অর্থমন্ত্রীকে অনেকে ব্যক্তিগতভাবে কটাক্ষ করেছেন, যা দুঃখজনক ও অনাকাঙ্ক্ষিত। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের মতে, এই অর্থমন্ত্রীই দেশের উন্নয়নের পথনকশাকারী।

বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী মুহা. ইমাজ উদ্দিন প্র
ামাণিক বলেন, অর্থমন্ত্রীকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে হবে। আবার তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, অর্থনীতি সফল হলে অর্থমন্ত্রীও সফল, প্রধানমন্ত্রীও সফল। এক মুখে সফল অর্থনীতি বলে আরেক মুখে ব্যর্থ অর্থমন্ত্রী বলবেন, এটা হয় না। সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী একজন দক্ষ ব্যক্তিত্ব এবং তাঁকে নিয়ে আমরা গৌরববোধ করি।’

জাতীয় পার্টির দুই সাংসদ জিয়াউদ্দিন আহমেদ ও কাজী ফিরোজ রশীদ গত মঙ্গলবার সংসদে অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি, বয়স হয়ে গেছে, বিদায় হন—এসব ভাষায় কথা বলেন। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীসহ সরকারের অন্য মন্ত্রীরাও বাজেটে কিছু প্রস্তাব নিয়ে মুহিতের সমালোচনায় মুখর ছিলেন। গতকাল সেসবেরই জবাব দেন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীরা। আগের দিন বুধবার কিছু জবাব দিয়েছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ।

বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ টানা ২২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। সিঙ্গাপুরের এক রাষ্ট্রনায়কও ছিলেন ২৫ বছর। এ দুটির মতো অনেকে দেশেই কোয়ালিশন সরকার রয়েছে। কিন্তু আমরা দুর্ভাগা দেশ, অস্থির জাতি। পাঁচ বছরেই অস্থির হয়ে যাই পরিবর্তন করতে হবে, পরিবর্তন করতে হবে। কেন পরিবর্তন করতে হবে?’

মানুষ আমাদের কাছে কী শিখবে

আবদুল মতিন খসরু বলেন, ‘তিনি একজন জ্যেষ্ঠ ব্যক্তি (সিনিয়র ম্যান)।
তাঁকে নিয়ে এভাবে কথা বলায় আমরা বিব্রত হয়েছি। এখানে (সংসদ) একজন মিথ্যা কথা বললে বলতে হয় আপনি অসত্য কথা বলেছেন। এটাই হচ্ছে সংসদের মান (স্ট্যান্ডার্ড অব পার্লামেন্ট)। আর আমরা যেভাবে কথা বলছি, মানুষ আমাদের কাছ থেকে কী শিখবে?’

জাতীয় পার্টির সাংসদদের উদ্দেশে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, ভ্যাট আইন সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে যাঁরা সংসদে ছিলেন, তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে অর্থমন্ত্রীকে কটাক্ষ করেছেন। এটা দুঃখজনক ও অনাকাঙ্ক্ষিত।

শিল্পমন্ত্রী বলেন, বাজেট সংসদের সম্পত্তি। এর খারাপ ও ভালো দিক থাকতে পারে। আলোচনা চলছে, ভালো দিকটা বেরিয়ে আসবে। সেই দিকে অপেক্ষা না করে সমালোচনার নামে কটাক্ষ করা ঠিক নয়। বাজেটে ১ হাজার ৪৩টি পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি আছে। বন্ধুরা কিন্তু সেগুলো উল্লেখ করেননি। তাঁরা শুধু সমালোচনাই করেছেন। আসলে স্বৈরশাসনের ফলে যাদের সৃষ্টি হয়েছে, তাদের চিন্তাধারা সে রকমই থেকে যায়।

সাংসদ আবু রেজা মো. নেজাম উদ্দিন বলেন, আবদুল মুহিত সৎ অর্থমন্ত্রী। দুই থেকে তিনটি বিষয় বাদ দিলেই আগামী বাজেট সুন্দর হয়ে যাবে।

কোনো গালাগালি নয়

অর্থমন্ত্রী ৯ বছরে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথনকশা এঁকেছেন জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘বাজেট দেওয়ার পর সংসদের ভেতরে-বাইরে, টিভি চ্যানেলের টকশোতে এত আলোচনা হয়েছে, যা আর কোথাও হয় না। এটাই নিয়ম, এটাই বৈশিষ্ট্য। জনগণের অনুভূতি আমরা বুঝতে পারি।’

নাসিম বলেন, ‘বাজেটের ভুল-ত্রুটি হতে পারে, সে জন্য সমালোচনাও হবে। তবে তা হতে হবে গঠনমূলক। কোনো গালাগালি নয়। সরকারদলীয় সাংসদেরাই সমালোচনা করছি, এটা তো ভালো। প্রাণবন্ত সংসদ। প্রাণবন্ত শুধু না, ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা রয়েছে এতে। কয়েক দিন বাজেটের ওপর পত্রিকায় প্রধান শিরোনাম (হেডলাইন) হয়েছে। আমাদের আক্রমণ করা হয়েছে। এটাই তো চাই।’

জাসদের সাংসদ এ কে এম রেজাউল করিম বলেন, ‘অর্থমন্ত্রীকে স্যালুট জানাই। কিছু সুবিধাভোগী জ্ঞানপাপীই তাঁর বিরোধিতা করেন।’

আত্মসাৎকারীরা ভি-চিহ্ন দেখায়

তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, বাজেটে অনেক দুর্বলতা রয়েছে। ব্যাংকে লুটপাট অব্যাহত আছে এবং দুর্নীতির সিন্ডিকেট সক্রিয়। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে দুর্নীতির সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎকারীরা জামিনে মুক্তি পেয়ে ভি-চিহ্ন দেখিয়ে যে বেরিয়ে আসে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

দেশে ৩০ লাখ মামলার তথ্য দিয়ে আবদুল মতিন খসরু বলেন, বিচার বিভাগের উন্নয়ন হলে দেশের উন্নয়ন হবে। কিন্তু প্রয়োজন অনুযায়ী বিচারক নেই দেশে। আইনের শাসনের ঘাটতি রয়েছে। বিচারকদের সংখ্যা দ্বিগুণ করা জরুরি। যদি ‘জাস্টিড ডিলেইড, জাস্টিড ডিনাইড’ হয়, তাহলে রাষ্ট্রের কারণে যেসব বিচার ডিনাইড হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে কী হবে?

জাতীয় পার্টির সাংসদ নুরুল ইসলাম বলেন, দুর্নীতি মারাত্মক রূপ নিয়েছে। বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতি নিয়ে ব্যাংকটির পরিচালক রেজাউর রহমান (বর্তমানে প্রয়াত) অর্থ মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দিয়েছিলেন। এ কারণে তাঁকে পরে সরিয়ে দেওয়া হয়। তখন যদি দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতো, ব্যাংকটির তাহলে এই দুরবস্থা হতো না।

তিনটি বিষয় নিয়ে হইচই

তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ব্যাংক আমানতের ওপর শুল্ক এবং সঞ্চয়পত্রের সুদ—এ তিন বিষয় নিয়ে হইচই হচ্ছে। এই তিনটি বিষয়ই কিন্তু বাজেট নয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। তিনি বলেন, সবাই অর্থমন্ত্রীর দিকে তির ছুড়ছেন, তাঁকে দোষারোপ করছেন। তিনি বাজেট দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায়। দিনবদলের ধারাবাহিকতার এই বিশাল বাজেট জাতীয় সক্ষমতা ও যোগ্যতার পরিচায়ক।

ব্যাংকে আমানতে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত কোনো টাকা না কাটা এবং সংবাদপত্রের ওপর প্রস্তাবিত ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের কথা বলে পরে আগামী অর্থবছরের (২০১৭-১৮) জন্য ভ্যাট আইনটিই স্থগিতের দাবি জানান তথ্যমন্ত্রী। বলেন, আইনটি নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। এ জন্য এক বছর স্থগিত রেখে বুঝিয়ে-শুনিয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে কার্যকর করা যায়।

 হাসানুল হক ইনু বলেন, ভ্যাট নিয়ে ঢালাওভাবে যে বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে, তিনি এর সঙ্গে একমত নন। তবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে ভ্যাট পদ্ধতি পছন্দও করেন না। কারণ, এটি ধনী আর গরিবকে এক পাল্লায় মাপে এবং এতে সবাইকে সমানভাবে কাটে।

শরীরের ভাষা পছন্দ হয়নি

জাতীয় পার্টির সাংসদ নুরুল ইসলাম বলেন, জিয়াউদ্দিন আহমেদ ও কাজী ফিরোজ রশীদ অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, আর সেই পরিপ্রেক্ষিতে সরকারদলীয় একজন যেভাবে কথা বলেছেন, তাঁর শরীরের ভাষাটা পছন্দ হয়নি।

নুরুল ইসলাম বলেন, ‘অতীতে বাজেট নিয়ে কী দেখেছি। এই বাজেট মানি না। গরিব মারার বাজেট—এসব লিখে বাজেট পেশের পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে যেতেন। আমরাই প্রথম বিরোধী দল যে এসব অপরাজনীতির পরিবর্তে বাজেট নিয়ে সংসদে কথা বলছি।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের পাশাপাশি সরকারি দলের নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, মোরশেদ আলম, জাহিদ আহসান রাসেল, রহিম উল্লাহ, আখতার জাহান, আয়শা ফেরদাউস ও শামছুন নাহার বেগম এবং ওয়ার্কার্স পার্টির হাজেরা খাতুন আলোচনায় অংশ নেন। ঈদ উপলক্ষে ২৮ জুন বিকেল চারটা পর্যন্ত বাজেট অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করেন ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়া। ২৯ জুন বাজেট পাস হওয়ার কথা।