'রাজনীতির কাছে অর্থনীতির পরাজয়'

মির্জ্জা আজিজ, নাজনীন আহমেদ, আহসান এইচ মনসুর ও খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম
মির্জ্জা আজিজ, নাজনীন আহমেদ, আহসান এইচ মনসুর ও খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

আগামী দুই অর্থবছরের জন্য স্থগিত করা হয়েছে নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) আইন। এ ছাড়া বাজেটে পরিবর্তন আনা হয়েছে ব্যাংক আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক হারেও। গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদে এসব পরিবর্তন এনে পাস হয় অর্থবিল।

প্রস্তাবিত বাজেটের অর্থবিলে এই পরিবর্তনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন অর্থনীতিবিদেরা। কেউ বলছেন, জনগণের স্বার্থে সঠিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। আবার কেউ বলছেন, ভোটের রাজনীতির কাছে হার হয়েছে অর্থমন্ত্রীর।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘কর আদায়ের ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত অর্থবিল পাসের সময় যে দুটি বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে, তাকে স্বাগত জানাচ্ছি। তবে বড় কথা হচ্ছে, এর ফলে রাজস্ব আদায়ে কী পরিবর্তন আসবে? গতকাল সংসদে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে বাজেটের আকার ও বরাদ্দে কোনো পরিবর্তনের কথা শুনিনি। তবে এটা নিশ্চিত, এই পরিবর্তনে রাজস্ব আদায় কমবে।’

রাজস্ব আহরণ ঠিক রাখতে ভ্যাট ও আয়কর জাল সম্প্রসারণের পরামর্শ দেন মির্জ্জা আজিজ। তিনি বলেন, করের আওতা বাড়িয়ে ও আদায়ের সক্ষমতা তৈরি করে আহরণে যে হ্রাস হচ্ছে, তা পূরণ করতে হবে। এ ছাড়া দুই বছর পর যখন থেকে এই আইন কার্যকর করা হবে, তখন আগে থেকে ঠিক করে নিতে হবে একক হারে এটা বাস্তবায়ন হবে কি না।

২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে নতুন ভ্যাট আইন ২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে বাস্তবায়নের ঘোষণা দেওয়া ছিল। কিন্তু বছরজুড়েই ব্যবসায়ীরা প্রবলভাবে এর বিরোধিতা করে আসছিলেন। এমনকি বাজেটের আগে পরামর্শক কমিটির বৈঠকে অর্থমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এ নিয়ে ব্যবসায়ী ও এনবিআর কর্মকর্তাদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হুমকির ঘটনাও ঘটে। তারপরও নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েই বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুই বছরের জন্য স্থগিতই রাখতে হলো নতুন ভ্যাট আইন।

এ বিষয়কে রাজনীতির কাছে অর্থমন্ত্রীর হার হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান—বিআইডিএসের জ্যেষ্ঠ গবেষক নাজনীন আহমেদ। তিনি বলেন, এই বাজেটে চমক বলতে ভ্যাট আইনটিই ছিল। রাজস্ব আদায় এই পরিবর্তনের জন্য কমে যাবে। সরকার এখন কোন দিকে সমঝোতা করবে, এটা ঠিক করতে হবে। উন্নয়নের ক্ষেত্রে কী সমঝোতা হবে?

নাজনীন আহমেদ মনে করেন, ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে এ পরিবর্তন অর্থনীতির জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। তিনি বলেন, ভোটের জন্য এমনটা করার প্রয়োজন হলে সরকার তা আগেই ভাবতে পারত। তাহলে নতি স্বীকার করে পরিবর্তন করতে হয়েছে—এমনটা মনে হতো না। এর ফলে রাজনীতির কাছে অর্থমন্ত্রীর পরাজয় হলো। অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, পরবর্তী বাজেট হবে নির্বাচনী বাজেট, কিন্তু এখন এই বাজেটটিই হয়ে গেল নির্বাচনী বাজেট।

এদিকে ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না করায় এলোমেলো পরিস্থিতিতে বাজেট কাঠামো থেকে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, বাজেটের ঘাটতিজনিত প্রতিক্রিয়ার সমন্বয় এখন একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল। বাজেটে রাজস্ব আদায়ে আয়কর থেকে ৩৬ শতাংশ ও ভ্যাট থেকে ৩৩ শতাংশ লক্ষ রাখা হয়েছিল। এই জায়গায় এখন একটা চাপ তৈরি হবে।

গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ভ্যাট অনেক কিছুর ওপর রাখা হয়নি। প্রচলিত উৎসের ওপর নির্ভর করেই ছিল। বাস্তবায়ন না হলে এখন ঘাটতির চাপ পড়বে। এখন সরকারকে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থায়ন করতে হবে। যা অর্থনীতির জন্য দুর্বলতা তৈরি করবে। অর্থমন্ত্রী যদি চার লাখ কোটি টাকার বেশি বাজেট কাঠামো না করে একটু ছাড় দিয়ে বাজেট কাঠামো করতেন, তাহলে ঘাটতি অর্থায়নের ক্ষেত্রে চাপ কম পড়ত।

গতকাল নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়া সম্পর্কে প্রতিক্রিয়ায় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের কাছে নতি স্বীকার করল সরকার। যে বড় সংস্কারের লক্ষ্য ছিল, তা সাহসের সঙ্গে এগিয়ে নিতে পারল না। এটা সরকারের ব্যর্থতা।