ভ্যাটের ধাক্কায় বাজেট এলোমেলো

নতুন ভ্যাট আইন থেকে পিছিয়ে আসায় এলোমেলো হয়ে গেছে নতুন বাজেট। নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আয়ের পরিকল্পনা ছিল অর্থমন্ত্রীর। আর বেশি আয়ের ওপর নির্ভর করেই বিশাল একটি বাজেট তৈরি করা হয়েছিল। সেই পরিকল্পনায় বড় ধরনের ধাক্কা খেলেন অর্থমন্ত্রী ও সরকার। ফলে বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেল বাজেট পাসের সঙ্গে সঙ্গেই।

জাতীয় সংসদে গতকাল বৃহস্পতিবার ২০১৭-১৮ অর্থবছরের নতুন বাজেট পাস হয়েছে। নতুন ভ্যাট আইন দুই বছরের জন্য স্থগিত করে এই বাজেট পাস করা হয়। ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। ফলে নির্বাচনের আগে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের আর কোনো সুযোগ রইল না। দুই বছরের জন্য স্থগিত করায় নির্বাচনের পরেই এই আইন বাস্তবায়নের সুযোগ পাওয়া যাবে। নির্বাচনের পরে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন নিয়ে নতুন সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

সবাইকে খুশি রাখার বাজেট

নতুন ভ্যাট আইন জাতীয় সংসদে পাস হয়েছিল ২০১২ সালে। এর আগে মন্ত্রিসভায় তা অনুমোদন পায়। জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার আগে রীতি অনুযায়ী অর্থ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হয়। এরও চার বছর পরে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দুবার ব্যর্থ হলেন অর্থমন্ত্রী।

পাসের পর আইনটির বিভিন্ন দিক নিয়ে ব্যবসায়ীদের আপত্তির মুখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করা হয়েছিল। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ হচ্ছে, কমিটির নেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেনি এনবিআর। তবে ব্যবসায়ীরা নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে আলোচনা করলেও সরকারের নিজের মধ্যে এ নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। এমনকি দলের মধ্যেও আলোচনা হয়নি। যদিও এটি ছিল ২০০৯ সালের পর থেকে অর্থনীতিতে সরকারের নেওয়া সবচেয়ে বড় সংস্কার প্রস্তাব, কিন্তু সেটিও বাস্তবায়ন করতে পারল না সরকার। ফলে এই বাজেটকেও একটি সংস্কারহীন বাজেট বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা।

বাজেট পেশের আগে ব্যবসায়ীরা নতুন ভ্যাট আইনের তুমুল বিরোধিতা করেছেন। বাজেট উপস্থাপনের পর নিজ দলের সাংসদেরাই ভ্যাট আইনের সমালোচনা করে বক্তব্য দিয়েছেন। আবার ভোক্তারাও শঙ্কিত ছিলেন আইনটি নিয়ে। কারণ, এতে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে বলে আশঙ্কা ছিল। নির্বাচনের দেড় বছর আগে সরকার কোনো পক্ষকেই অসন্তুষ্ট করতে চায়নি। জনরুষ্ট থেকে জনতুষ্টির বাজেট করার আগ্রহ থেকেই শেষ মুহূর্তে এই পরিবর্তন।

সমাপনী বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজেও বলেছেন, করদাতাদের তিনি সন্তুষ্ট করতে পারেননি।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, নতুন ভ্যাট আইন উড়তে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে বা এর ‘ক্রাশ ল্যান্ডিং’ হয়েছে। কেন এমনটি হলো? এ নিয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কোনো ধরনের টেকনিক্যাল প্রস্তুতি সম্পন্ন না করে, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ঐকমত্য সৃষ্টি না করে এবং সামাজিক তাৎপর্য অনুধাবন না করে একটি ভালো উদ্যোগ কীভাবে নষ্ট হতে পারে, নতুন ভ্যাট আইন এরই প্রমাণ।

পরিবর্তন নজিরবিহীন

বাজেট দেওয়ার পরে জাতীয় সংসদে আলোচনা শেষে পাসের সময় কিছু কিছু পরিবর্তন আনা রীতিতে পরিণত হয়েছে। প্রতিবারই ছোটখাটো পরিবর্তন আনা হয়। তবে এবার ভ্যাট আইন স্থগিত করার মতো যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, এমনটা অতীতে আর কখনো দেখা যায়নি। কারণ নতুন ভ্যাট আইন ছিল এবারের বাজেটের সবচেয়ে বড় রাজস্ব প্রস্তাব। এতে বাজেট বাস্তবায়নের ওপর এর প্রভাবও পড়বে বেশি।

এর আগে ২০০৫ সালে বাজেট পাসের দেড় মাসের মাথায় আমদানি শুল্কের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছিল। সে সময় অর্থমন্ত্রী ছিলেন এম সাইফুর রহমান। মূলত বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে প্রায় সাড়ে তিন হাজার পণ্যের শুল্ক হারে পরিবর্তন এনেছিলেন তিনি। এভাবে শর্ত পূরণ করে ৩০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়া গিয়েছিল।

২০০৫ সালে দাতাদের কারণে পরিবর্তন আনা হলেও এবার বরং ভ্যাট আইন করার জন্যই বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের পরামর্শ ছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীদের চাপ ও দলের সদস্যদের সমালোচনার মুখেই ভ্যাট আইন স্থগিত করা হলো। এর মাধ্যমে ২০০৫-কে ছাড়িয়ে গেল ২০১৭।

সাবেক মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এম হাফিজ উদ্দিন খান এ নিয়ে বিবিসিকে বলেছেন, সংসদে অধিকাংশ সদস্য ব্যবসায়ী। প্রধানমন্ত্রী স্বীকারও করেছেন যে ব্যবসায়ীদের অনীহার কারণে তিনি ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন দুই বছরের জন্য পিছিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। সাধারণ মানুষের আপত্তি ছিল, তাদের কথা কিন্তু শোনা হয়নি।

এলোমেলো আর্থিক কাঠামো

ভ্যাট আইন ছাড়া বাজেট পাস হলেও বাজেটের আর্থিক কাঠামোর কোনো পরিবর্তন আনেননি অর্থমন্ত্রী। ফলে ৪ লাখ ২৬৬ হাজার কোটি টাকার বাজেটকেই বাস্তবায়ন করতে হবে। এর মধ্যে অনুন্নয়ন ব্যয় ২ লাখ ৩৪ হাজার ১৩ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন ব্যয় ১ লাখ ৫৯ হাজার ১৩ কোটি টাকা। অন্যদিকে এই ব্যয় নির্বাহের জন্য রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনা হচ্ছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) খাতেই আদায়ের কথা আছে ৯১ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। মোট রাজস্ব আদায় পরিকল্পনার মধ্যে ভ্যাটের অংশই সবচেয়ে বেশি, ৩৬ দশমিক ৮ শতাংশ।

ভ্যাট থেকে বিদায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আদায়ের লক্ষ্য হচ্ছে ৬৮ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরের তুলনায় ভ্যাট থেকে আদায় বেড়েছিল মাত্র ১৪ হাজার ৯৯ কোটি টাকা। আর নতুন অর্থবছরে বাড়াতে হবে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। এই হারে ভ্যাট আদায় এর আগে কখনোই এনবিআর করতে পারেনি। ফলে বাজেটের আয়-ব্যয়ে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন স্থগিত করায় অবশ্যই রাজস্ব আদায় কমবে। ফলে এবার লক্ষ্য ও আদায়ের মধ্যে তফাত বাড়বে। তা ছাড়া, পাস করা বাজেটটি সার্বিকভাবে অবাস্তব ও উচ্চাভিলাষী। এমন বাজেট তো বছরের শেষ দিকে এসে কাটছাঁট করতেই হবে।

কোথায় পড়বে খড়্গ

প্রতিবছর জুনের শুরুতে অর্থমন্ত্রী বিশাল আকারের একটি বাজেটের ঘোষণা দিয়ে বাহবা পান। কিন্তু অর্থবছরের শেষ দিকে এসে সেই বাজেটের বড় ধরনের সংশোধন করা হয়। এর মধ্যে উন্নয়ন বাজেট বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার কাটছাঁট করা হয় সবচেয়ে বেশি। নতুন ভ্যাট আইন না হওয়ায় এবার এডিপির কাটছাঁট হবে সবচেয়ে বেশি।

নির্বাচন এগিয়ে এলে এডিপিতে সবচেয়ে গুরুত্ব বেশি বাড়ে রাস্তাঘাট নির্মাণ প্রকল্পে। সংসদ সদস্য বা নির্বাচন করতে আগ্রহীদের চাপে রাস্তাঘাট নির্মাণের অসংখ্য প্রকল্প নেওয়া হয়। যেমন এবার পরিবহন খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট এডিপির প্রায় ২৭ শতাংশ। অথচ আগের অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ ছিল ২৭ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। নির্বাচনের প্রাক্কালে পরিবহন খাতের এই বরাদ্দ খুব বেশি কমানো হবে না বলেই পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে। বড় বড় প্রকল্প থাকায় এবার বরাদ্দ বেড়েছে বিদ্যুৎ খাতেও। বড় প্রকল্প শেষ করতে হবে বলে এখানেও বরাদ্দ কমানোর সুযোগ কম। উন্নয়ন বাজেটের বাইরে বেতন, ভাতা, পেনশন, সুদ পরিশোধ খাতের মতো অনুন্নয়ন বাজেটে ব্যয় কমানোর সুযোগ একেবারেই অর্থমন্ত্রীর নেই। এ অবস্থায় বাজেট কমানোর খড়্গ শেষ পর্যন্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতের ওপরই পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

তারপরও আবগারি শুল্ক

এবারের বাজেটে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা ছিল ব্যাংক আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক নিয়ে। সাধারণত কোনো বিষয়কে নিরুৎসাহিত করতে আবগারি শুল্ক বসানো হয়। ১৯৯১ সালে ভ্যাট আইন চালুর পরে আবগারি শুল্ক প্রথা তুলে দিলেও বিমান টিকিট ও ব্যাংক খাতে রেখে দেওয়া হয়েছিল। আমানতের সুদ এখন মূল্যস্ফীতির হারের তুলনায় কম। ফলে ব্যাংকের আবগারি শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত সাধারণ আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায় বেশি।

আবগারি শুল্ক হারে পরিবর্তন আনা হলেও বাতিল করা হয়নি। যদিও আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী এই খাত থেকে মাত্র ৯৫০ কোটি টাকা আদায় হবে বলে এনবিআরের প্রাক্কলন ছিল। এর পরিবর্তে পুরো আবগারি শুল্ক বাতিল করলেই ভালো হতো বলে মনে করেন অনেকে।

আবগারি শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহারের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, মূলধনের ওপর কখনো আবগারি শুল্ক বসতে পারে না। আবগারি শুল্ক বসানোর মূল দর্শন হলো কোনো কিছুকে নিরুৎসাহিত করা। মদ, গাঁজা, তামাক—এসব পণ্যের ওপর আবগারি শুল্ক বসতে পারে। ব্যাংক হিসাবের ওপর কোনোভাবেই আবগারি শুল্ক নয়। এ খাত থেকে খুব বেশি টাকা রাজস্বও আসে না। ব্যাংক হিসাবের ওপর বিভিন্ন সেবামাশুল কাটে; এর ওপর আবগারি শুল্কও আছে। এত টাকা কাটলে মানুষ বিরক্ত হবে। তাদের কাছে খারাপ বার্তা যায়।

চাপ বাড়াবে বাজেট

কাল শনিবার থেকে নতুন অর্থবছর শুরু। বাজেট বাস্তবায়নও শুরু হবে কাল থেকে। বড় পরিবর্তন হলেও বাজেটের আর্থিক কাঠামোর পরিবর্তন নিয়ে কোনো বক্তব্য দেননি অর্থমন্ত্রী। সুতরাং নিয়ম অনুযায়ী নতুন বাজেট বাস্তবায়ন করতে হলে এনবিআরকে এখন আগের তুলনায় ৩৩ শতাংশ বেশি ভ্যাট আদায় করতে হবে, পুরোনো আইনে যা সম্ভব হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। কেননা, ২০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি কখনোই অর্জন করতে পারেনি এনবিআর। এ অবস্থায় বাজেটের দ্রুত সংশোধন বা রাজস্ব আদায়ের অন্য কোনো বিকল্প খুঁজে বের করার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদেরা। তা না করতে পারলে রাজস্ব আদায়ের অতিরিক্ত চাপ বাড়বে ভোক্তার ওপরে। তাতে সাধারণ মানুষেরই কষ্ট বাড়বে।

আরও পড়ুন: