১০ বছর পর বড় সংকট

সূত্র: ইউএসডিএ
সূত্র: ইউএসডিএ

বিশ্বের চতুর্থ চাল উৎপাদনকারী দেশ বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম প্রধান আমদানিকারকে পরিণত হয়েছে। প্রায় ১০ বছর পর নতুন করে চালের সংকটে পড়ে বিশ্বের প্রধান চাল রপ্তানিকারক দেশগুলো থেকে আমদানির চেষ্টা করছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে চাল আমদানিই এখন সরকারের একমাত্র ভরসা।

চার বছর ধরে সরকারি খাতে কোনো চাল আমদানি হয়নি। কিন্তু এ বছর বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে হাওরের ফসল নষ্ট হওয়ার পর চালের সংকট দেখা দেয়। সরকারি পর্যায়ে আমদানির পাশাপাশি বেসরকারি খাতকে উৎসাহ দিতে শুল্ক কমানো হয় ১৮ শতাংশ। এত সব উদ্যোগের প্রায় দুই মাস হতে চলল। কিন্তু এখনো চালের সংকট থেকে বেরোতে পারেনি বাংলাদেশ।

গত দুই মাসে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ৫৭ হাজার টন চাল সরকারি গুদামে এসেছে। তবে চালের সরকারি চাহিদার তুলনায় তা সামান্যই। ১৭ লাখ টন ধারণক্ষমতার সরকারি গুদামে বর্তমানে চাল আছে মাত্র ২ লাখ ৭৩ হাজার টন। এখনো খোলা বাজারে পুরোদমে চাল বিক্রি শুরু করতে পারেনি খাদ্য অধিদপ্তর। অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির কার্যক্রমও সীমিত করা হয়েছে।

চালের দাম কমাতে আরেক দফায় ৫% শুল্ক কমানোর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) অনুরোধ করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এতে প্রতি কেজি চালের আমদানি মূল্য দেড় টাকার মতো কমবে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আগাম ঘোষণা দেওয়ায় বাড়তি লাভের আশায় ব্যবসায়ীরা চাল আমদানি কার্যত বন্ধ রেখেছেন। দেশের স্থলবন্দর–গুলোতে আসা চাল খালাসও বন্ধ হয়ে আছে।

সরকারি সূত্রগুলো বলছে, গত মে-জুনে চালের দর অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে খাদ্য মন্ত্রণালয় চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে। আমদানি শুল্ক কমানোর জন্য এনবিআর থেকে সিদ্ধান্ত আসে আরও দেরিতে, জুনের শেষ সপ্তাহে। ওই সময় শুল্ক কমানোর সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা আমদানি শুরু করলে সারা দেশে, বিশেষত চট্টগ্রাম ও খুলনায় বৃষ্টি বেড়ে গেলে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর দিয়ে চাল খালাসেও বিলম্ব হতে থাকে। ফলে বাজারে দামের ওপরে প্রভাব পড়ে সামান্যই।

সামগ্রিক বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম এম শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, সরকার সংকট মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নিতে যদি সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে, তাহলে তার খেসারত তো দিতেই হবে। এ বছর যেভাবে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে, তাতে সামনে খাদ্য নিয়ে আরও বড় সংকট দেখা দিতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে
হলে খাদ্য মন্ত্রণালয়কে জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে।

দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দরে খালাসের অপেক্ষায় আছে ভারত থেকে আমদানি করা চালবাহী ট্রাকের সারি। ছবিটি গত শুক্রবার বেলা তিনটায় তোলা l প্রথম আলো
দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দরে খালাসের অপেক্ষায় আছে ভারত থেকে আমদানি করা চালবাহী ট্রাকের সারি। ছবিটি গত শুক্রবার বেলা তিনটায় তোলা l প্রথম আলো

উদ্যোগ অনেক, আমদানি কম

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত চাল আমদানির জন্য ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সঙ্গে বছরে মোট ৩০ লাখ টন চাল আমদানির চুক্তি হয়েছে। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে আমদানির ব্যাপারে আলোচনা চলছে। এর মধ্যে ভিয়েতনাম থেকে আড়াই লাখ টন আমদানির জন্য চুক্তি হয়ে গেছে। পাশাপাশি আরও ৪ লাখ টন চাল আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে আমদানির উদ্যোগ নিয়ে এ পর্যন্ত ৩ লাখ টনের চুক্তি করা হয়েছে। আরও ১ লাখ টনের জন্য দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া শেষের পথে।

এই বিপুল পরিমাণ চাল আমদানির সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি হওয়ার পরও গত দুই মাসে ভিয়েতনাম থেকে রাষ্ট্রীয় চুক্তির মাধ্যমে আসা ৫৩ হাজার টন ও আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে আসা ৪ হাজার ৭০০ টন চাল বন্দর থেকে খালাস হয়েছে। সুতরাং প্রয়োজনের তুলনায় চাল কম আমদানি হওয়ায় বাজারে প্রভাব পড়েনি।

তবে খাদ্যমন্ত্রী মনে করছেন, দেশে চালের কোনো সংকট নেই। বাজার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে। সামনের দিনে আমদানি বাড়লে দাম আরও কমে আসবে। সরকারিভাবে তো দেশে মাত্র ১০ লাখ টন চালের ঘাটতির কথা বলা হয়েছিল, তাহলে কেন এত চাল আমদানির চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হচ্ছে। মন্ত্রীকে এই প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আমরা সব দুয়ার খুলে রাখছি, যাতে ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা না হয়।’

গত জুনে চালের আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করার পর বেসরকারি খাতে আমদানি কিছুটা বেড়েছিল। মূলত চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ এবং যশোরের নওয়াপাড়া ও ঢাকার কয়েকজন আমদানিকারক আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করেন। এর মধ্যে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড থেকে আতপ চাল এবং বাকি দুই এলাকার ব্যবসায়ীরা সেদ্ধ চাল আমদানি শুরু করেন।

১০ বছর পর আবার সংকট

চাল নিয়ে একই ধরনের সমস্যা দেশে তৈরি হয়েছিল ২০০৭-০৮ সময়ে। ওই দুই বছর বন্যায় দেশের ২৫ লাখ টন চাল উৎপাদন কমলে চালের দাম কেজিপ্রতি ৪০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। আর এবার মোটা চাল ৪৮ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত হয়। তবে প্রথম দফায় আমদানি শুল্ক কমানোর পর মোটা চালের দর ৩ টাকা কমলেও এখন তা বেড়ে গেছে।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদর অনুযায়ী, বাজারে সরু ও মোটা চালের দর কেজিতে ১ টাকা বেড়েছে। গত সপ্তাহে সরু চাল প্রতি কেজি ৫২ থেকে ৫৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গতকাল শনিবার তা বেড়ে ৫২ থেকে ৬০ টাকা হয়েছে। মোটা চালের কেজিও ছিল ৪২ থেকে ৪৫ টাকা। গতকাল তা ৪৩ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক বছরে মোটা চালের দর প্রায় ৩৮ শতাংশ বেড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর হিসাব অনুযায়ী, ২০০৭ সালে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২০ লাখ ৪৭ হাজার টন চাল আমদানি হয়। ২০০৮ সালে চালের আমদানি ৭ লাখ ৩২ হাজার টনে নেমে আসে। তবে এ সময়ে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষকেরা ভালো দাম পাওয়ায় ২০০৯ সালে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। ফলে আমদানি কমে ৯২ হাজার টনে নেমে আসে।

২০১৩ সালে আবারও ৭ লাখ ৮০ হাজার টন, ২০১৪ সালে ১২ লাখ ৫১ হাজার টন চাল আমদানি হয় দেশে। এ সময় আমদানি নিয়ন্ত্রণে দুই দফায় ২৮ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। ২০১৫ সালে আমদানি কমে ১ লাখ ১৭ হাজার টন ও ২০১৬ সালে ৭০ হাজার টনে নেমে আসে। আর ২০১৭ সালের প্রথম ছয় মাসে চালের আমদানি হয়েছে ৭ লাখ টন।

অন্যদিকে, ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে মোট ৩ কোটি ৩৭ লাখ টন চালের উৎপাদন হয়। এরপর ২০১৪-১৫ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে চালের উৎপাদন বছরে ৩ লাখ টন করে বাড়তে থাকে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এসে উৎপাদন বৃদ্ধির হার থেমে যায়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চাল উৎপাদিত হয় ৩ কোটি ৪৫ লাখ টন। চলতি অর্থবছরে তা কমে ৩ কোটি ৪১ লাখ ৮০ হাজার টন হতে পারে।

চাল সংকট মোকাবিলায় নেওয়া সরকারের উদ্যোগ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মো. শাহাবুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, এবার হাওরে ফসলহানির পর কতটুকু চাল কীভাবে আমদানি হবে, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে অনেক দেরি হয়েছে। চাল নিয়ে সংকট সামনে আরও বাড়তে পারে, সে জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দক্ষতা আরও বাড়াতে হবে।