বন্ড সুবিধা নিয়ে ৭৮ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি

গত ১০ মাসে ৩২টি বন্ডেড প্রতিষ্ঠানের গুদাম ও নানা স্থানে অভিযান চালিয়ে এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা উদ্‌ঘাটন করেছেন এনবিআরের বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা

বন্ড সুবিধার অপব্যবহার হচ্ছে। বন্ড সুবিধার আওতায় ৭৮ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা খুঁজে পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এনবিআর বলছে, শুল্ক ও কর না দিয়ে অর্থাৎ বন্ড সুবিধা নিয়ে বিদেশ থেকে পণ্য এনে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কেউ রপ্তানির নামে কাপড়, সুতা এনে কারখানায় না নিয়েই রাজধানীর ইসলামপুরসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করে দিয়েছেন। আবার কেউ বন্ড সুবিধায় সুতা এনে তা বিক্রি করে দিয়েছেন।

গত ১০ মাসে ৩২টি বন্ডেড প্রতিষ্ঠানের গুদাম ও নানা স্থানে অভিযান চালিয়ে এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা উদ্‌ঘাটন করেছেন এনবিআরের বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই বস্ত্র খাতের। এ জন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়েছে।

এ বিষয়ে এনবিআরের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান গত মঙ্গলবার মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন্ডের অপব্যবহার রোধ করতে এনবিআর এখন অনেক বেশি সক্রিয়। বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের কারণে প্রতিবছর ৬০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছি। এই টাকা দিয়ে প্রতিবছর দুটি পদ্মা সেতু করা যেত। এমনকি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) কোনো বিদেশি সহায়তা লাগত না।’ তিনি জানান, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার বন্ধে ব্যবসায়ীরা সহায়তা করছেন।

ময়মনসিংহের ভালুকায় অবস্থিত তৈরি পোশাক কোম্পানি এক্সপেরিয়েন্স টেক্সটাইল লিমিটেড। বন্ড কমিশনারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই প্রতিষ্ঠানটি বন্ড সুবিধায় কাঁচামাল হিসেবে বিদেশ থেকে গ্রে ফেব্রিকস আনে। গুদাম থেকে অবৈধভাবে এই বন্ড পণ্যটি সরিয়ে ফেলে এই প্রতিষ্ঠানটি দুই দফায় ৫৫ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে বলে শুল্ক কর্মকর্তারা সরেজমিনে গিয়ে দেখতে পান। প্রথমবার গত ডিসেম্বর মাসে ১০ কোটি ৪১ লাখ টাকা এবং এ বছরের এপ্রিল মাসে ৪৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা উদ্‌ঘাটন করেন রাজস্ব কর্মকর্তারা।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে ওই প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক আনোয়ার পারভেজ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই দুটি ঘটনা নিয়ে মামলা চলছে। আদালত যে রায় দেবেন, তা-ই মেনে নেব।’ তিনি দাবি করেন, তাঁর প্রতিষ্ঠান কোনো রাজস্ব ফাঁকি দেয়নি। এনবিআরের নথি অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত ৪৪ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই সময়ে প্রতিষ্ঠানটির রপ্তানির পরিমাণ মাত্র ৭ থেকে ৮ কোটি টাকা।

মেসার্স আইডিয়াল পলিমার এক্সপোর্ট লিমিটেড তৈরি পোশাকের পশ্চাৎপদ শিল্প হিসেবে কাজ করে। প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং পণ্য বানায় এবং প্রচ্ছন্ন রপ্তানিকারক হিসেবে বন্ড সুবিধা পায়। গত ১২ সেপ্টেম্বর এই প্রতিষ্ঠানের ১০ লাখ ৯০ হাজার টাকার আটটি কাভার্ড ভ্যান আটক করেন বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা। ১৫ হাজার ৭৫২ কেজি আর্ট কার্ড চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সরাসরি ভালুকায় অবস্থিত প্রতিষ্ঠানের গুদামে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা পুরান ঢাকায় বিক্রি করার গোপন সংবাদ পেয়ে তা আটক করেন বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা। এতে শুল্ক ফাঁকির পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৬ লাখ টাকা।

বন্ড কমিশনারেটের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বন্ড সুবিধার আওতায় ১ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে—এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা সাতটি। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের রুমানা এক্সেসরিজ ইন্ডাস্ট্রিজ ২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা, তিথি টেক্সটাইল মিলস ১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, কনফিডেন্স স্টিল এক্সপোর্ট লিমিটেড ৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, বোনাফাইড নিটিং মিলস লিমিটেড ১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা; গাজীপুরের নোভা এক্সেসরিজ ১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা, ইলফাত পলি প্যাকেজিং অ্যান্ড এক্সেসরিজ ১ কোটি ৯১ লাখ টাকা এবং নরসিংদীর আবেদ টেক্সটাইল প্রসেসিং মিলস লিমিটেড ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান রপ্তানি করার জন্য কাঁচামাল এনে তা ব্যবহার করেনি; গুদাম থেকে কাঁচামাল সরিয়ে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে।

রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো প্যাসিফিক থ্রেড অ্যান্ড এক্সেসরিজ ইন্ডাস্ট্রিজ, টেক্সাস প্যাকেজেস অ্যান্ড এক্সেসরিজ লিমিটেড, রূপালী এক্সেসরিজ ইন্ডাস্ট্রিজ, কাশফি নিটওয়্যারস, নাইস ডেনিম মিলস লিমিটেড, কোকো প্যাকেজিং ইত্যাদি।

ব্যবসায়ীরা এনবিআরের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের বন্ড সুবিধা নেন। এই সুবিধা সবচেয়ে বেশি নেন রপ্তানিকারকেরা। বন্ড সুবিধা থাকলে বিদেশ থেকে কাঁচামাল আনলে তাতে শুল্ক ও কর দিতে হয় না। শর্ত থাকে, সেই কাঁচামাল পুরোপুরি ব্যবহার করে আবার রপ্তানি করতে হবে এবং সময় দুই বছর। এ জন্য বন্দর দিয়ে কী পরিমাণ পণ্য বন্ড সুবিধায় এসেছে, এর যেমন হিসাব রাখতে হয়, আবার ওই প্রতিষ্ঠানের ওয়্যারহাউসে কতটা রক্ষিত আছে, কী পরিমাণ ব্যবহৃত হয়েছে, সেই হিসাবের সঙ্গেও মিল থাকতে হয়। তৈরি পোশাক খাত ও এর পশ্চাৎপদ শিল্পের প্রতিষ্ঠানগুলো এই সুবিধা বেশি নিয়ে থাকে।

এ ছাড়া দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদার জন্য কিছু পণ্যে বন্ড সুবিধা দেওয়া হয়। যেমন চিনিশিল্প। অপরিশোধিত চিনি বা ‘র সুগার’ দেশে এনে তা প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি করা হয়। কিন্তু এই ‘র সুগার’ আনার সময়ও বন্ড সুবিধা পাওয়া যায়। অবশ্য পরিশোধিত করে কারখানা থেকে সরবরাহ পর্যায়ে ওই অপরিশোধিত চিনির শুল্ক ও কর দিতে হয়। এটিকে সাময়িক বন্ড সুবিধা হিসেবে অভিহিত করা হয়।