উগ্র জাতীয়তাবাদ বড় দুশ্চিন্তা, নোটবন্দী ব্যর্থ

কৌশিক বসু
কৌশিক বসু

বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর মতে, কালোটাকার বিস্তার ঠেকাতে ভারতের নোটবন্দী উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। এই উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ায় ভারতের অর্থনীতি বহুমুখী সংকটে পড়েছে। এর ফলে দেশটির উচ্চ প্রবৃদ্ধিতে মন্দা দেখা দিয়েছে, বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে ব্যবসায়ীদের মনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। তাঁর মতে, দেশটিতে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য আরও বেশি দুশ্চিন্তার।

ভারতের অর্থনীতি নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এ লেখা এক বিশ্লেষণী কলামে এসব মত তুলে ধরেছেন কৌশিক বসু। তিনি মনে করেন, অর্থনৈতিক সংস্কারে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ইতিমধ্যে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এসব ভুল শোধরানো না হলে ভারতের অর্থনীতির জন্য অদূর ভবিষ্যতে কোনো ভালো খবর আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

কলামের শুরুতে কৌশিক বসু বলেছেন, ভারতের অর্থনীতি এখন একটি জটিল সন্ধিক্ষণে আছে। দুই বছর আগে চীনকে হটিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির গৌরব অর্জন করেছিল ভারত। কিন্তু গত এক বছরে সেই গৌরব হারিয়ে গেছে। জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমছে, ব্যবসায় আস্থার পরিবেশের ঘাটতি দেখা দিয়েছে, রপ্তানির তুলনায় আমদানির পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে।

অর্থনীতির এ দুরবস্থার জন্য দুটি বিষয় সামনে এনেছেন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক কৌশিক বসু। প্রথমটি হলো, গত বছরের নভেম্বরে ৫০০ ও ১ হাজার রুপির সব নোট বাতিল বা নোটবন্দীর ঘোষণা। প্রাথমিকভাবে এ সিদ্ধান্তকে দুর্নীতিবাজ সম্পদশালীদের ওপর সাধারণ নাগরিকের বিজয় বলা হলেও এটি গুরুতরভাবে ভারতের অনানুষ্ঠানিক খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ভারতের সিংহভাগ জনগোষ্ঠী এখনো অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মসংস্থান ও নগদ অর্থের লেনদেনের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু সরকার সেটা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে।

কৌশিক বসু লিখেছেন, দুঃখজনকভাবে এ উদ্যোগের ফলে দৃশ্যত কোনো কালোটাকাই ধ্বংস হয়নি। অবৈধভাবে কামানো প্রায় সব অর্থই ধনীরা গরিবদের কাজে লাগিয়ে বদলে নিয়েছে। নীতিনির্ধারণে ভুল হতে পারে, কিন্তু বিষয়টি নিয়ে সরকার যেভাবে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে সাফল্যের দাবি করছে, তাতে ব্যবসায়িক পরিবেশে আস্থার ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আরও ঘটতে পারে, ব্যবসায়ীদের মনে এখন এ ভয় তৈরি হচ্ছে।

ভারতের অর্থনৈতিক গতি মন্দার দ্বিতীয় কারণ হিসেবে কৌশিক বসু হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থানকে উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে তিনি কলামে বলেছেন, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের উত্থানের বিষয়টি ভারতের অর্থনীতির জন্য বেশি দুশ্চিন্তার। কারণ এটি ভারতের উদার মনোভাব, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য হুমকিস্বরূপ। শুধু অনানুষ্ঠানিক খাতের ছোট ব্যবসায়ীরাই নন, বড় করপোরেট কোম্পানিগুলোও বর্তমান সামাজিক অবক্ষয় নিয়ে চিন্তিত।

কৌশিক বসুর মতে, ৭০ বছর আগে যে মূল্যবোধ নিয়ে স্বাধীন ভারত যাত্রা শুরু করেছিল, আজকের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ তার বিপরীত। স্বাধীনতার পর অর্থনৈতিক উন্নয়নের আগে ভারত গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতার মতো বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। ১৯৯০-এর পর থেকে ভারতের অর্থনৈতিক অগ্রগতি শুরু হয়। এতে একটা বিষয় পরিষ্কার ছিল, অর্থনৈতিক উন্নয়নের আগে গণতন্ত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।

কৌশিক বসু মনে করেন, অর্থনীতির বর্তমান সংকট কাটাতে হলে ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে প্রথমে ভুল স্বীকার করার মানসিকতা অর্জন করতে হবে। উগ্র ডানপন্থীদের লাগাম অবশ্যই টেনে ধরতে হবে। কারণ এসব গোষ্ঠী ভারতকে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে ফেলছে। তাদের রাশ যদি না টানা হয় তাহলে উচ্চ প্রবৃদ্ধির যে আশা ভারতীয়রা করছে, সেটি শিগগিরই অর্জন করা কঠিন হবে।