ভুতুড়ে ঋণের গল্প

এ বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি। ঢাকার মতিঝিলে এক বন্ধুর সঙ্গে চা খাচ্ছি। আমার বন্ধুটি বেশ আলাপী। রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি—নানান বিষয়ে গল্প হচ্ছে। বেশির ভাগ সময় আমিই শ্রোতা। হঠাৎ দেশের ব্যাংক খাতের দুরবস্থা নিয়ে সে খুব উচ্চকণ্ঠ। আমি যতবারই ‘কাজ আছে’ বলে উঠতে চাচ্ছি, ততবারই সে নতুন গল্প বলে আমাকে আটকাচ্ছে। সব গল্পই শুরু করে সে ‘আরে ব্যাটা, শোন না’ বলে।

ওর শেষ গল্পটিই আমাকে আকৃষ্ট করে বেশি। বন্ধুটির এক আত্মীয়ের কাহিনি। এবার আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছি। একটু পরপরই জানতে চাইছি, ‘তারপর, তারপর?’

আমি বললাম, ‘গায়ত্রী দে কি এখন ঢাকায়?’

বন্ধু বলল, ‘হ্যাঁ।’

অনুরোধ করলাম, ‘আমার সঙ্গে ফোনে একটু কথা বলিয়ে দে।’

কথা বলিয়ে দিল। কথা হলো গায়ত্রী দের সঙ্গে। সচিব জগন্নাথ দের স্ত্রী তিনি। জগন্নাথ দে মারা গেছেন ২০১১ সালে। ফোনে কথা বলে ঠিক করলাম তাঁর সঙ্গে দেখা করার দিনক্ষণ। তারপর ঠিক করা দিনে চলে গেলাম তাঁর বাসায়।

গায়ত্রী দে জানালেন, কদিন হলো তিনি ইংল্যান্ড থেকে এসেছেন। বেশি দিন থাকবেনও না। তাঁর কাছ থেকে জগন্নাথ দের নামে আসা বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের (বিকেবি) ১০ কোটি টাকা পরিশোধের তাগাদাপত্রটি সংগ্রহ করলাম। তাগাদাপত্রের একটা জবাবও দেন তিনি ব্যাংককে। সেটাও আমাকে দেখালেন। বাড়তি কপি না থাকায় মোবাইল ফোনে ছবি তুলে নিলাম।

আগেই বলেছি, গায়ত্রী দের স্বামী মারা গেছেন ২০১১ সালে। অথচ ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখা তাঁর নামে ২০১২ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত বছরের পর বছর ঋণ দিয়ে গেছে! এই ঋণের সুবিধাভোগী আবার বিডি প্লান্টেশন নামের একটা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও অন্য পরিচালকেরা।

কোনো ঝামেলায় যাতে না পড়েন, এমন শঙ্কাসহ গায়ত্রী দে বিদায় দিলেন আমাকে। আর আমি সোজাসুজি চলে গেলাম যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয়ে (আরজেএসসি)। কারণ, আমাকে জানতে হবে প্রতিষ্ঠানটির কোন পরিচালকের নামে কত শেয়ার আছে। সহজেই পেয়ে গেলাম এবং দেখলাম, জগন্নাথ দের নামে মাত্র ৫০টি শেয়ার আছে। বেশির ভাগ শেয়ারের মালিক প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বুদ্ধদেব মুখার্জি।

পরদিন বিকেবির কারওয়ান বাজার শাখায় গিয়ে ব্যবস্থাপকের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি জানালেন, ঘটনাটি এই শাখায় তাঁর আসার আগের। শাখা থেকে জানতে পারি, ঋণ দেওয়ার সময়ের ব্যবস্থাপক এখন প্রধান কার্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন।
তার পরদিন বিকেবির প্রধান কার্যালয়ে গেলাম বিকেবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং ওই ব্যবস্থাপকের বক্তব্য নিতে। তাঁরা দুজনই ইনিয়েবিনিয়ে কথাবার্তা বলতে লাগলেন। ব্যবস্থাপক কিছু ভুল হওয়ার কথাও স্বীকার করলেন।
সবার সঙ্গেই কথা হয়েছে, কিন্তু ঘটনার পেছনের মূল ব্যক্তির সঙ্গে আর কথা হয়ে উঠছে না। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ফোন করলেও তিনি রিসিভ করছেন না। খুদেবার্তা পাঠালেও কোনো জবাব নেই। মহাচিন্তায় পড়ে গেলাম।
একদিন জাতীয় প্রেসক্লাবে কফি খাচ্ছি। প্রেসক্লাবেরই এক সদস্যকে কথায় কথায় বললাম, এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করে কথা বলা দরকার, কিন্তু তাঁকে পাচ্ছি না। ওই সদস্য জানালেন যে আমি যাকে খুঁজছি তিনিও প্রেসক্লাবের সদস্য এবং তিনি দুপুরের পর ক্লাবে আসেন। দুদিন দুপুরের পর প্রেসক্লাবে বসে থেকেও তাঁর দেখা পেলাম না। পরে একদিন পেয়ে গেলাম এবং কথাও বললাম। তিনি যথারীতি পত্রিকায় প্রতিবেদন না করার অনুরোধ করলেন।
সব পক্ষের বক্তব্যসহ প্রতিবেদন তৈরির কাজ শেষ করলাম এ বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি। ৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হলো ‘মৃত সচিবের নামে ঋণ দিয়েছে কৃষি ব্যাংক’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি।
এখন এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকও তদন্ত করছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তদন্ত দল কৃষি ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখায় এসে জিজ্ঞাসাবাদ করে গেছে।