ইউরোপে তিন পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষে বাংলাদেশ

ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলো সারা বছর যে পরিমাণ টি-শার্ট বা গেঞ্জি কেনে, তার প্রায় ৪১ শতাংশই বাংলাদেশি পোশাক কারখানা সরবরাহ করে। ফলে ছয় বছর ধরে ইইউতে টি-শার্ট রপ্তানিতে শীর্ষ অবস্থানে আছে বাংলাদেশ।

কেবল টি-শার্ট নয়, পাঁচ বছর ধরে ট্রাউজার ও শর্টস প্যান্ট এবং চার বছর ধরে পুরুষ বা বাচ্চাদের শার্ট রপ্তানিতে ইইউতে সবার ওপরে বাংলাদেশ। গেল বছর ইইউর চাহিদার ৩০ দশমিক ৯২ শতাংশ শার্ট এবং ৩৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ ট্রাউজার ও শর্টস রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ।

ইইউভুক্ত ২৮ দেশ গত বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৮ হাজার ১২৩ কোটি ইউরো বা ৭ লাখ ৭১ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকার তৈরি পোশাক কিনেছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৪ শতাংশ বা ২ হাজার ৭৭৭ কোটি ইউরোর পোশাক রপ্তানি করেছে চীন। তারপরই বাংলাদেশ, রপ্তানি করেছে ১ হাজার ৪৯৬ কোটি ইউরো বা ১ লাখ ৪২ হাজার ১৪০ কোটি টাকার পোশাক। তৃতীয় অবস্থানে আছে তুরস্ক, তাদের পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ৯৫২ কোটি ইউরো।

ইউরোপিয়ান কমিশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর বাংলাদেশ থেকে ইইউতে রপ্তানি হওয়া পোশাকের প্রায় ৪০ শতাংশই টি-শার্ট, পুরুষ বা বাচ্চাদের শার্ট এবং ট্রাউজার ও শর্টস প্যান্ট (কটন)। ট্রাউজারের মধ্যে ডেনিম বা জিনস প্যান্ট আছে। সেখানেও বাংলাদেশ শীর্ষে। যদিও মেয়েদের ট্রাউজারসহ আরও কয়েকটি পণ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। তবে রপ্তানির পরিমাণ ও বাজার হিস্যার বিবেচনা করলে টিশার্ট, পুরুষ বা বাচ্চাদের শার্ট এবং ট্রাউজার ও শর্টস প্যান্ট শীর্ষে।

নব্বইয়ের দশক থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে আসছে বাংলাদেশ। ইতিমধ্যে সারা বিশ্বে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। শুরু থেকেই টি-শার্ট রপ্তানি করে এলেও ২৫ বছর পর ২০১১ সালে ইইউতে শীর্ষে পৌঁছে বাংলাদেশ। তার আগ পর্যন্ত তুরস্কই সর্বোচ্চ পরিমাণ টি-শার্ট রপ্তানি করত ইউরোপের বাজারে। পেছনে ফিরলে দেখা যায়, ২০০৬ সালে ১১৯ কোটি ইউরোর টি-শার্ট রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। ১০ বছরের ব্যবধানে সেটি আড়াই গুণ বেড়ে গত বছর ৩০২ কোটি ইউরোতে দাঁড়িয়েছে।

ইইউভুক্ত দেশগুলো গত বছর ৭৪০ কোটি ইউরো বা ৭০ হাজার ৩০০ কোটি টাকার টি-শার্ট কিনেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ৪০ দশমিক ৮১ শতাংশ রপ্তানি করেছে। তুরস্ক ২৬ শতাংশ বা ১৯৬ কোটি ইউরো ও চীন ১৬ শতাংশ বা ১১৭ কোটি ইউরোর টি-শার্ট বা গেঞ্জি রপ্তানি করেছে।

গত বছর ২৮৭ কোটি ইউরোর শার্ট কিনেছিল ইইউর দেশগুলো। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে গেছে ৮৮ কোটি ৭৪ লাখ ইউরো বা ৮ হাজার ৪৩০ কোটি টাকার শার্ট। ২০১০ সালে মাত্র ৩৬ কোটি ইউরোর শার্ট রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। তার মানে গত সাত বছরে পুরুষ বা বাচ্চাদের শার্ট রপ্তানি আড়াই গুণ বেড়েছে। অন্যদিকে এ সময় চীনের শার্ট রপ্তানি দেড় গুণ কমে এসেছে। গত বছর দেশটি রপ্তানি করেছে ৪৭ কোটি ইউরোর শার্ট। তারাই দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। তৃতীয় অবস্থানে থাকা তুরস্ক রপ্তানি করেছে ৩৪ কোটি ৮৯ লাখ ইউরোর শার্ট।

ইইউভুক্ত দেশগুলো গত বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৬০২ কোটি ইউরোর ট্রাউজার ও শর্টস আমদানি করে। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে গেছে ২০৬ কোটি ইউরোর পণ্য। এ ছাড়া তুরস্ক ৮১ কোটি ৮০ লাখ ইউরো, পাকিস্তান ৭৭ কোটি ৯৩ লাখ এবং চীন ৭২ কোটি ইউরোর ট্রাউজার ও শর্টস রপ্তানি করে। ২০১২ সালে চীনকে হটিয়ে ইইউতে ট্রাউজার ও শর্টস রপ্তানিতে বাংলাদেশ শীর্ষে পৌঁছায়।

ট্রাউজার ও শর্টসের মধ্যে ডেনিম বা জিনস প্যান্ট আছে। গত বছর ২৭০ কোটি ইউরোর ডেনিম আমদানি করে ইইউ। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকেই সর্বোচ্চ ২৮ শতাংশ বা ৭৬ কোটি ৫৬ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে পাকিস্তান, রপ্তানি করেছে ৫৩ কোটি ১০ লাখ ইউরোর ডেনিম। পরের অবস্থানে থাকা তুরস্ক ৫৩ কোটি ইউরোর ডেনিম রপ্তানি করে।

সস্তা শ্রম, বড় পরিমাণে পোশাক তৈরির সক্ষমতা ও দক্ষতা এবং সময়মতো সরবরাহ করার নিশ্চয়তার কারণেই ইউরোপের বাজারে টি-শার্ট, ট্রাউজার ও শার্ট রপ্তানিতে বাংলাদেশ শীর্ষে পৌঁছাতে পেরেছে বলে মন্তব্য করেন তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি (অর্থ) মোহাম্মদ নাছির। তিনি বলেন, নতুন নতুন অনেক কারখানা হচ্ছে। ফলে সক্ষমতাও বাড়ছে। কেবল লিড টাইম কমানো গেলেই ইইউতে পোশাক রপ্তানি অনেক বাড়ানো সম্ভব।

অভিমত: অর্জনের ভিতটা অনেক দিনের

ক্রেতারা যে ধরনের পোশাক সব সময় বেশি পরিমাণে কেনে, তার মধ্যে টি-শার্ট, ট্রাউজার ও ছেলেদের শার্ট প্রধান। এসব পোশাক উৎপাদন করব, এমন মানসিকতা নিয়েই বাংলাদেশের পোশাকশিল্প বড় হয়েছে। এটাই আমাদের পছন্দের জায়গা। যেমন ভারতের পোশাকমালিকেরা ছোট ছোট পরিমাণের অনেক ধরনের পোশাকের ক্রয়াদেশের কাজ করেন। এসবে আমরা অভ্যস্ত না। প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে। উল্টো দিকে বড় পরিমাণে কাজ করতে শুরু থেকেই আমরা পারদর্শী। ক্রেতারাও আস্থা রাখছেন। তাই তিন ধরনের পোশাকের অর্জনটি বেশি দিনের না হলেও ভিতটা অনেক দিনের। এটি এক দিনে হয়নি। করতে করতে আমরা এক নম্বর হয়েছি।

বিশ্বে পোশাক রপ্তানিতে আমরা প্রথম হতে চাই। সেটি করতে হলে টি-শার্ট, ট্রাউজার ও শার্টের শীর্ষ জায়গাটি ছেড়ে দেওয়া যাবে না। ক্লাসের ফার্স্ট বয় হতে গেলে কেবল অঙ্ক-ইংরেজি নয়, সব বিষয়েই ভালো করতে হবে। তাই এটিকে রেখেই ছোট ছোট পরিমাণের বৈচিত্র্যময় পোশাক তৈরিতে অগ্রসর হতে হবে। এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি কিছুটা হয়েছে, তবে সেটি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছায়নি। আমাদের দক্ষতা, যন্ত্রপাতি ও কারিগরি দিক থেকে দক্ষ পর্যাপ্ত বিদেশি জনবল আছে। ক্রেতারাও আমাদের বৈচিত্র্যময় পোশাক তৈরির ক্রয়াদেশ দিতে চান। কিন্তু আমাদের পোশাকশিল্প মালিকদের দূরদৃষ্টির অভাব রয়েছে। একটা ব্যবসা ঠিক রেখে যে আরেকটি করা যায়, সে বিষয়ে তাঁরা উদ্যোগী নন।

ফজলুল হক, সাবেক সভাপতি, বিকেএমইএ