সি চিন পিংয়ের লক্ষ্য কী

সি চিন পিং দ্বিতীয় মেয়াদে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন।
সি চিন পিং দ্বিতীয় মেয়াদে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন।

সেদিন একটি মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, মাওবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ফিরে আসছে চীন। বেইজিং সরকার তথা ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) ১৯তম কংগ্রেসে এক কর্মকর্তা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে বলেন, তাঁর গ্রামের চোলাই কারখানায় একধরনের পানীয় বিক্রি হয় ৯৯ ইউয়ানে (চীনের মুদ্রা)। তখন সি চিন পিং বলেন, এটি একটু বেশিই মনে হচ্ছে। কমাতে হবে। তখন ওই কর্মকর্তা প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁর নির্দেশ অনুসরণের অঙ্গীকার করেন।

তখনই প্রেসিডেন্ট হঠাৎ তাঁকে থামিয়ে মুখ টিপে হেসে বলেন, ‘আমি বলেছি বলেই এটি কমিয়ে ৩০ ইউয়ানে আনবেন না। এটি বাজারের সিদ্ধান্ত।’ প্রেসিডেন্টের এই বক্তব্যে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল উপস্থিত ব্যক্তিরা। প্রেসিডেন্টের দাম বেঁধে দেওয়ার কোনো ইচ্ছাই নেই।

সম্প্রতি সি চিন পিং দ্বিতীয় মেয়াদে প্রায় নয় কোটি সদস্যবিশিষ্ট দলটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। তার মানে, আগামী পাঁচ বছর তিনি চীনের প্রেসিডেন্টও থাকছেন। সাধারণ চীনারা কেউ কেউ ‘আংকেল সি’ বলতে শুরু করেছে। বয়স তাঁর ৬৪।

বাজার নিয়ন্ত্রণের কোনো অভিপ্রায় না থাকলেও সত্যিকার অর্থে কী করতে যাচ্ছেন সি চিন পিং? তাঁর কাছে এ প্রশ্ন বেসরকারি কোম্পানিগুলোরও। সি চিন পিংকে নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তিনি কতটা সমাজতন্ত্রী, কতটা পুঁজিতন্ত্রী আর কতটা জাতীয়তাবাদী—এসব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ আছে বিশ্বময়।

প্রশ্ন হলো, সি চিন পিং যদি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ শিথিল করতে চান, চীনা সরকারব্যবস্থা কি তাঁকে তা করতে দেবে? কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে সিপিসির আদর্শিক ও ব্যবহারিক অবস্থান সমাজতান্ত্রিক। পুঁজিবাদের সঙ্গে এই সরকারব্যবস্থার মতানৈক্য তো বহুদিনের। এ অবস্থায় দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা প্রেসিডেন্টের একটি নতুন যুগের অঙ্গীকার কি নতুন পরিকল্পনার চেয়ে সেই একই অবস্থাই নির্দেশ করবে?

প্রেসিডেন্টের বক্তব্যে এটা পরিষ্কার যে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা রয়েছে সিপিসির কাছে। ক্ষমতার প্রয়োগও দেখিয়েছে সিপিসি। পার্টি ইতিমধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এন্টারপ্রাইজের (এসওইএস) ওপর নিয়ন্ত্রণ পুনর্ব্যক্ত করেছে এবং বেসরকারি ব্যক্তিদের ওপরও প্রভাব বিস্তার করেছে। শিল্পোদ্যোক্তাদের আরও বেশি দেশপ্রেমিক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সরকার। সেই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোও আতঙ্কিত করে তুলছে ব্যবসায়ীদের।

উদ্বেগের বিষয় হলো, পুঁজিবাদকে কঠোর হাতে দমনের লক্ষ্যে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো চীনের অন্যতম চারটি কোম্পানির বিষয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যাচাই করেছে। এগুলো হলো, বিমা কোম্পানি আনব্যাং, অ্যাভিয়েশন থেকে পর্যটন গ্রুপ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া এইএসএ, আবাসনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়ান্ডা এবং শিল্পগোষ্ঠী ফোসান। আর এর ফলে চলতি বছরে এই চার কোম্পানির বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে অনেক। ওয়ান্ডা তাদের অনেক হোটেল সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছে। এমনকি আনব্যাংয়ের প্রতিষ্ঠাতাকে আটক করা হয়েছে।

উদ্যোক্তাদের ওপর অবশ্য এটি কোনো ধরনের খড়্গ নয় বলেই মনে করছে সিপিসি। হুরুনের ২ হাজার ১৩০ জনের ধনীর তালিকা থেকে গত বছর মামলায় ফেঁসেছেন মাত্র পাঁচজন। অন্যদিকে প্রেসিডেন্টের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে পাঁচ বছরের ২০৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় ১০ শতাংশই ফাঁদে আটকেছে।

আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে প্রযুক্তি খাতের ওপর। গত মাসে ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সামাজিক মিডিয়া যেমন ইয়োকো, আলিবাবা’স ইউটিউব প্ল্যাটফর্ম, ওয়েবো, চায়না’স আনসার টু টুইটারের ১ শতাংশ অংশ নিতে পারবে। অবশ্য সব সময়ই চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে সরকার। তারা ক্ষমতাসীন দলের সুনাম করেই কাজ করে। কিছুদিন আগে চীন সরকারের হাতে ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য তুলে দেওয়ার ঘোষণা দেয় আরেক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উইচ্যাট। নিরাপত্তাসংক্রান্ত এক বিবৃতিতে তারা জানিয়েছে, লম্বা সময়ের জন্য হয়তো তারা ব্যবহারকারীদের তথ্য ধরে রাখতে, সংরক্ষণ ও প্রকাশ করতে পারে। সেখানে তারা স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দেয়, সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সরকারি কোনো দপ্তর যদি তথ্য চায়, তাহলে তারা তা সরবরাহ করবে। কোর্ট অর্ডার বা আইনি প্রক্রিয়ার কাজেও তারা তথ্য সরবরাহের কথা জানায়।

সবশেষ উদ্বেগের বিষয় হলো সি চিন পিংয়ের ইচ্ছা করপোরেট জগতে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব শক্তিশালী করা। সি চিন পিংকে যাকে ইতিমধ্যে মাও সে তুং-পরবর্তী চীনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলে বিবেচনা করা হচ্ছে, দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে শত শত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এন্টারপ্রাইজ তাদের আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশনে সংশোধন এনেছে। বড় বড় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে পার্টি কমিটির পরামর্শ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়েছে তারা। নিয়ন্ত্রক সংস্থাও গত বছর প্রযুক্তিনির্ভর কোম্পানিগুলোকে ক্ষমতাসীন দলের প্রচারে মনোযোগ দিতে নির্দেশ দিয়েছে। এমনকি নিজেদের সদস্যদের গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োগ দিচ্ছে সিপিসি। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান টেনসেটের ২৩ শতাংশ কর্মী সরকারদলীয়; আর যাঁদের মধ্যে ৬০ শতাংশই উল্লেখযোগ্য অবস্থানে আছে।

তবে এগুলো চীনের জন্য নতুন কিছু নয়। ৯০-এর দশকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর ক্ষমতাসীন দল দলীয় সংগঠন প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যক্তিগত সংস্থাগুলোকে চাপ দেয়। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক সাহায্যপ্রাপ্ত কোম্পানিগুলোর প্রায় এক-পঞ্চমাংশই এক ছিল। সংস্থাগুলোর বড় বড় সিদ্ধান্ত পার্টি নেওয়ার চেষ্টা করেছে—এর প্রমাণও স্পষ্ট রয়েছে।

অবশ্য কোম্পানিগুলো এই নিয়ন্ত্রণ পছন্দ না করলেও ব্যবসা-বাণিজ্যে কোনো নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হচ্ছে না। সি চিন পিংয়ের প্রথম পাঁচ বছরের মেয়াদে শিল্প মুনাফা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১০ শতাংশ বেড়েছে, যা কিনা গত চার দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। পার্টি জানে, সুস্থ অর্থনীতির জন্য একটি গতিশীল বেসরকারি খাত প্রয়োজন।

তাই সি চিন পিং না চাইলেও একক নেতৃত্বের যে ক্ষমতা রয়েছে, এর প্রভাব থেকেই যাচ্ছে। অর্থনীতিতে এটিই অন্যতম ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। কারণ, গ্রামের ভাটিখানার সেই দোকানে ওই পানীয় অল্প কিছুদিন পরই ৩০ ইউয়ানে বিক্রি হতে থাকে।

দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে শাকিলা হক