সাবেক চেয়ারম্যান বাচ্চুর কি দায়বদ্ধতা নেই?

বেসিক ব্যাংক
বেসিক ব্যাংক

বেসিক ব্যাংকে অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনায় দায়ের করা মামলায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও দক্ষতার অভাব আছে বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, ‘আর্থিক অনিয়মের মামলায় আসামি ধরার ক্ষেত্রে পিক অ্যান্ড চুজ (সুবিধামতো বাছাই) হচ্ছে। কমিশনের আচরণ এমন হওয়ায় নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। নিরপেক্ষতা আপনাদের প্রমাণ করতে হবে।’

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল বুধবার দুদক কৌঁসুলিকে এ কথা বলেন। বেসিক ব্যাংকে ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় করা পৃথক মামলায় তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক মো. সেলিমের জামিন প্রশ্নে রুল শুনানিতে আদালত এসব কথা বলেন। পাশাপাশি এত বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনায় ব্যাংকটির তখনকার চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর দায়বদ্ধতা ছিল কি না, সেই প্রশ্ন রেখেছেন আদালত। মামলার এজাহারে তাঁর নাম না থাকার বিষয়টি নিয়েও আদালত প্রশ্ন তুলেছেন।

আদালতে সেলিমের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী শাহদীন মালিক ও এম মনজুর আলম। দুদকের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান ও এ কে এম ফজলুল হক।

আদালত বলেন, বোর্ড কী করেছে? বোর্ড দেখেছে সুপারিশ নেই, সিআইবি রিপোর্ট নেই। তাহলে কীভাবে ঋণ অনুমোদন দিয়েছে? এজাহারে তো বোর্ড সদস্যের নাম নেই। তখন খুরশীদ আলম খান বলেন, একজনের নাম আছে। আদালত বলেন, মামলাটি কবে হয়েছে। জবাবে খুরশীদ আলম খান বলেন, ২০১৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। আদালত বলেন, যাঁরা ঋণ নিয়েছেন বা সুবিধাভোগী, তাঁদের গ্রেপ্তার করেছেন? খুরশীদ আলম বলেন, সময় দিলে জানানো যাবে। আদালত বলেন, জানাবেন বলে প্রতিনিয়ত সময় নিলে তো হবে না।

খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘জনবলসহ আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। ওই ঘটনায় ৫৬টি মামলা হয়েছে। যার মধ্যে পাঁচটিতে অভিযোগপত্র দাখিলের জন্য অনুমোদন পর্যায়ে রয়েছে। গোপনীয়তা ফাঁস হওয়ায় অনেককে গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না। একজন কর্মকর্তা ১৫০টি মামলা দেখছেন। তখন আদালত বলেন, জনবলসংকট থাকলে বছরে ১০টায় হাত দেবেন। একসঙ্গে ১০০টি মামলায় হাত দিয়ে বছরের পর বছর ধরে তদন্ত করবেন, এটি তো হতে পারে না। এ মামলায় কতজন গ্রেপ্তার আছেন? জবাবে খুরশীদ আলম খান বলেন,পাঁচজন। আদালত বলেন, কেউ কারাগারে থাকবেন, কেউ বাইরে থাকবেন। ‘পিক অ্যান্ড চুজ’ হচ্ছে।

আদালত বলেন, মামলার তদন্ত কোন পর্যায়ে রয়েছে? খুরশীদ আলম খান বলেন, তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। আদালত বলেন, এটি ভেগ টার্ম। খুরশীদ আলম খান বলেন, ৫৬টির মধ্যে ৪৮টি মামলার কাজ শেষ পর্যায়ে। আবদুল হাই বাচ্চুর বিষয়টি বাকি আছে, ব্যাংকের তখনকার দুজন বোর্ড সদস্য দেশের বাইরে থাকায় জিজ্ঞাসাবাদ করা যাচ্ছে না।

আদালত বলেন, দুই বছর ধরে যেভাবে ঝুলিয়ে রেখেছেন, তাতে পালাবার সুযোগ পেয়েছে। অর্থ নিয়ে কি তারা বসে থাকবে?

শুনানির এই পর্যায়ে আদালত বলেন, এজাহারে বোর্ড সদস্যদের নাম থাকা উচিত ছিল। বোর্ডের কোনো সদস্যের নাম এজাহারে নেই। জবাবে খুরশীদ আলম খান বলেন, ব্যাংকটির তখনকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও বোর্ড সদস্য কাজী ফখরুল ইসলামের নাম আছে। অন্যরাও আসবে, এখনো অভিযোগপত্র দাখিল হয়নি।

আদালত বলেন, হাজার হাজার কোটি টাকা বেসিক ব্যাংক থেকে নিয়ে গেছে, চেয়ারম্যানের (তখনকার চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু) কি দায়বদ্ধতা নেই? তাঁর নাম এজাহারে নেই।

গুলশান শাখার তখনকার শাখা ব্যবস্থাপক শিপার আহমেদের মামলায় হাইকোর্টের দেওয়া পর্যবেক্ষণ টেনে খুরশীদ আলম খান বলেন, শিপার আহমদের বক্তব্য বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। দুদক আদালতের কোনো আদেশ হালকাভাবে নেয় না। ছয় মাস সময় এখনো শেষ হয়নি। একটু সময় লাগছে।

তখন আদালত বলেন, কমিশন যদি হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ দেখত, তাহলে পরদিনই সবাইকে গ্রেপ্তার করা উচিত ছিল। তদন্ত কর্মকর্তাকে দুদক বলত, গ্রেপ্তার করা হোক। এত টাকাপয়সা নিয়ে তারা কি বসে থাকবে? কমিশন কীভাবে নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা ও দক্ষতা প্রমাণ করবে? বেসিকের মতো আর্থিক অনিয়মের মামলায় কমিশনের স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও দক্ষতার অভাব আছে।

দুদক কৌঁসুলি খুরশীদ আলম খানকে উদ্দেশ করে আদালত আরও বলেন, এটি অজ্ঞাতপরিচয়ের মামলা নয়, যে ক্লু বের করতে হবে, সময় লাগবে। এটি স্বচ্ছ একটি অপরাধ, গোপনীয়তার কিছু নেই। বেসিক ব্যাংক বসে ছিল, ঋণ দেওয়ার জন্য। সকালে প্রস্তাব এসেছে, বিকেলে তা দিয়ে দিয়েছে। এ জন্য একটি লোক দুই বছর ধরে ভুগছে।

খুরশীদ আলম খান বলেন, তাঁদের (জামিন আবেদনকারী) কাজের জন্যই তাঁরা ভুগছেন। তাঁরা আপত্তি জানালে আবদুল হাই বাচ্চু ও ফজলুল সোবহানের মতো ব্যক্তিরা সাহস পেতেন না।

বেসিক ব্যাংকে ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় করা পৃথক সাত মামলায় হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করেন সেলিম। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট জামিন প্রশ্নে রুল দেন। রুলের ওপর শুনানি নিয়ে আদালত তিনটি মামলায় মো. সেলিমের জামিন মঞ্জুর করেন। বাকিগুলো আগামী সপ্তাহে শুনানি হতে পারে।

গতকাল শুনানির শুরুতে সেলিমের আইনজীবীরা বলেন, ঋণ প্রস্তাব পর্যালোচনা কমিটিতে সাধারণত ১০ থেকে ১৫ জন সদস্য থাকেন, আবেদনকারী (সেলিম) কমিটির একজন সদস্য ছিলেন। ঋণ পর্যালোচনা কমিটির কার্যবিবরণী তুলে ধরে আবেদনকারীর আইনজীবী বলেন, ঋণ প্রস্তাবে দুর্বলতা আলোচনা করে সেলিমসহ কমিটির অন্যরা ঋণ মঞ্জুরের জন্য কোনো সুপারিশ করেননি। তা সত্ত্বেও বোর্ড ঋণ অনুমোদন দেয়। তাই ঋণ অনুমোদন দেওয়ায় তাঁর (সেলিম) ওপর দায় বর্তায় না। অনুমোদন না দেওয়া সত্ত্বেও তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ ভিত্তিহীন। ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে প্রায় দুই বছর ধরে সেলিম কারাগারে আছেন।

পরে দুদক কৌঁসুলি খুরশীদ আলম খান বলেন, সেলিম ঋণ পর্যালোচনা কমিটির একজন সদস্য ছিলেন। ঋণ প্রস্তাব বাতিল বা অস্বীকার করে মত দেওয়া তাঁর দায়িত্ব ছিল। ক্রেডিট পলিসি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুসারে তিনি তথ্য যাচাই-বাছাই করবেন। তা না করে সেলিম ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি পাঠিয়ে দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, ঋন কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রে একটি চেইন কাজ করে, একা হয় না। তাঁর বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ আছে। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতাও রয়েছে।

আইনজীবী সূত্র বলেছে, বেসিক ব্যাংকে ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় ২০১৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বর ৫৬টি মামলা করে দুদক, যেখানে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। ওই সব মামলায় ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলামসহ আসামির সংখ্যা শতাধিক।