শীর্ষ খেলাপিদের নিয়ে বিপাকে ন্যাশনাল ব্যাংক

ন্যাশনাল ব্যাংক
ন্যাশনাল ব্যাংক

শীর্ষ খেলাপিদের নিয়ে বিপাকে পড়েছে প্রথম প্রজন্মের ন্যাশনাল ব্যাংক। এসব খেলাপি থেকে ব্যাংকটি অর্থ আদায় করতে পারছে না, কোনো আইনি ব্যবস্থাও নিতে পারছে না। ফলে প্রতিনিয়ত সুদ যুক্ত হয়ে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ।

আবার, প্রায় ৯ মাস ধরে ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দিয়ে চলছে ব্যাংকটি। যদিও ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, ৩ মাসের বেশি ভারপ্রাপ্ত এমডি দিয়ে ব্যাংক পরিচালনার সুযোগ নেই। আইনে বলা আছে, এমন পরিস্থিতিতে প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টি জেনেও রয়েছে নীরব দর্শকের ভূমিকায়।

ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদার। তাঁর পরিবারের ছয় সদস্য ব্যাংকটির পরিচালক। বর্তমান সরকারের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত জয়নুল হক সিকদারের মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল, বিদ্যুৎ প্রকল্প, চা-বাগান, আবাসনসহ নানা ব্যবসায় বিনিয়োগ রয়েছে।

ন্যাশনাল ব্যাংকের শীর্ষ পাঁচ খেলাপি গ্রাহক হলো সাফারি ট্রেডার্স, ইপসু ট্রেডিং, কেমব্রিজ ইন্টারন্যাশনাল, ড্রিমওয়ার্ল্ড পার্ক ও মনোয়ারা ট্রেডিং। এসব খেলাপি গ্রাহকের কাছেই ব্যাংকটির পাওনা ৬৮৬ কোটি টাকা।

সব মিলিয়ে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে গত জুনে হয়েছে ২ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১১ শতাংশ। এর মধ্যে শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছেই আটকে আছে ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। অনিয়মের কারণে ২০১৪ সালের অক্টোবর থেকে ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতেও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না।

এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে ব্যাংকটির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক চৌধুরী মোসতাক আহমেদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেও কথা বলা যায়নি। তাঁর দপ্তরে গেলেও কথা বলেননি তিনি।
পরে ব্যাংকটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এস এম বুলবুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘শীর্ষ খেলাপিদের থেকে ঋণ আদায়ের চেষ্টা চলছে। অনেকে কিছু টাকাও দিয়েছেন। সব মিলিয়ে ব্যাংকটিকে ভালোর দিকে নিয়ে যাওয়ায় চেষ্টা করছি আমরা।’

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা খেলাপি হলেও ব্যাংকটি গত মার্চ-জুন সময়ে আদায় করতে পেরেছে মাত্র ১৭০ কোটি টাকা। ওই সময়ে নতুন করে ১২০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয়। অবলোপন করা ঋণ থেকে আদায় হয় ১৪০ কোটি টাকা। গত জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি রাখার কথা ছিল ১ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা, রাখতে পেরেছে ৯৬৮ কোটি টাকা।

জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যাংকটির আয় বেড়েছে। ১০ টাকার প্রতিটি শেয়ারে কোম্পানিটির মুনাফা হয়েছে ৪৩ পয়সা। আগের বছর একই সময়ে ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ছিল ১৬ পয়সা। তবে ৯ মাসের (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) হিসাবে ব্যাংকের মুনাফা কমেছে। এ সময়ে সমন্বিত ইপিএস কমে হয়েছে ৮৮ পয়সা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১ টাকা ৩ পয়সা।

অনিয়মের ঋণই এখন খেলাপির শীর্ষে: ব্যাংকটির শীর্ষ দুই খেলাপি গ্রাহক ইপসু ট্রেডিং ও কেমব্রিজ ইন্টারন্যাশনাল। এর মধ্যে ইপসুর কাছে পাওনা ১৪৫ কোটি টাকা ও কেমব্রিজের কাছে ১৩৫ কোটি টাকা। এসব ঋণ বিতরণ করা হয় ২০১৩ সালে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৫ সালেই এসব ঋণ প্রদানে অনিয়ম, ব্যবহার ও সুবিধাভোগী নিয়ে প্রশ্ন তোলে। সে সময় ব্যাংকটিকে এক চিঠিতে বলা হয়েছিল, এসব ঋণের প্রকৃত সুবিধাভোগী সিকদার রিয়েল এস্টেট। যার কর্ণধার ব্যাংকটির চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকটির নিমতলী শাখায় ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল ইপসু ট্রেডিংয়ের নামে হিসাব খোলার দুই দিন পরই ৪০ কোটি টাকার ঋণ ছাড় করা হয়। এ অর্থ দিয়ে সিকদার রিয়েল এস্টেটের জেড এইচ সিকদার শপিং কমপ্লেক্সের জায়গা (ফ্লোরের) কেনা হয়। মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার নিমতলী বাজারের এই শপিং কমপ্লেক্সে প্রতি বর্গফুট জায়গার দাম ১২ হাজার ৮২০ টাকা ধরা হয়, যা বাজারমূল্য অনুযায়ী কয়েক গুণ বেশি।

এ ছাড়া ব্যাংকের সীমান্ত স্কয়ার শাখায় ২০১৩ সালের ১৩ মে কেমব্রিজ ইন্টারন্যাশনাল হিসাব খুলেই ভবন ক্রয়ের জন্য ১৩২ কোটি টাকা ঋণের আবেদন করে গ্রাহক। পরদিন ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির সভায় তা অনুমোদনও হয়। এরপর ভবন বিক্রেতা ও ব্যাংকের পরিচালক মনোয়ারা সিকদারের অনুকূলে পে অর্ডারের মাধ্যমে ২২ মে ৫৫ কোটি, ২৭ মে ৫৫ কোটি ও ২৮ মে ৪১ কোটি ছাড় করা হয়। এ ক্ষেত্রেও প্রতি বর্গফুট ফ্লোর কেনা হয় ১২ হাজার টাকায়। যার প্রকৃত সুবিধাভোগী ব্যাংকের পরিচালকেরা।

শীর্ষ খেলাপি যারা: সাফারি ট্রেডার্সের ঋণ ১৫৭ কোটি টাকা, ইপসু ট্রেডিংয়ের ১৪৫ কোটি, কেমব্রিজ ইন্টারন্যাশনালের ১৩৬ কোটি, ড্রিমওয়ার্ল্ড পার্কের ১৩৩ কোটি, মনোয়ারা ট্রেডিংয়ের ১১৭ কোটি, সগির অ্যান্ড ব্রাদার্সের ১২১ কোটি, জালাল অ্যান্ড সন্সের কাছে ৭২ কোটি, ল্যান্ডমার্কের ইঞ্জিনিয়ারের ৬৬ কোটি, আহাদ ট্রেডিংয়ের ৬৪ কোটি, শাহ জুট অ্যান্ড প্লাস্টিকের ৪৩ কোটি, যমুনা এগ্রোর ৩১ কোটি, সিনহা সিকিউরিটিজের ২২ কোটি, মীম ট্রেডিংয়ের ২০ কোটি, সিনহা প্রোপার্টিজের ১৯ কোটি, সিটাডেল প্রোপার্টিজের ১৯ কোটি, এইচআর গ্রুপের ১৯ কোটি, নিউএজ টোব্যাকোর ১৭ কোটি, ফা অ্যাপারেল ১৮ কোটি ও মনসুর অ্যান্ড ব্রাদার্সের ১৬ কোটি টাকা।

ভারপ্রাপ্ত এমডি দিয়ে চলছে ৯ মাস: ব্যাংকটির এমডি শরিফুল ইসলামের মেয়াদ শেষ হয় গত ৩১ জানুয়ারি। ১ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত এমডি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) চৌধুরী মোসতাক আহমেদকে। এরপর আর ভারমুক্ত হতে পারেননি তিনি।

সূত্র জানায়, ব্যাংকটির বনানী শাখা থেকে গত বছরের ডিসেম্বরে ২০০ কোটি টাকা ঋণ নেয় প্রিমিয়ার প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্ট। এ ঋণের একমাত্র ব্যক্তিগত জামিনদার প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও সাবেক সাংসদ এইচ বি এম ইকবাল। কিন্তু ঋণের অর্থ ব্যবহার না করে অনুমোদনের এক সপ্তাহের মধ্যেই পুরো টাকাটাই তুলে স্থায়ী আমানত (এফডিআর) হিসেবে জমা করা হয় প্রিমিয়ার ব্যাংকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিশেষ তদন্তে এসব অনিয়ম ধরার পর পুরো টাকা ফিরিয়ে আনতে (কল ব্যাক) ন্যাশনাল ব্যাংককে নির্দেশ দিলেও তা ফেরাতে পারেনি ব্যাংকটি। এ ঋণের বিষয়ে চৌধুরী মোসতাক বাংলাদেশ ব্যাংককে মিথ্যা তথ্য দেন বলে এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে। এ কারণেই তাঁকে পূর্ণাঙ্গ এমডি পদের নিয়োগ আটকে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।