অগ্রণীর ৬০ কোটি টাকা আত্মসাৎ

অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার দায়ে মুন গ্রুপের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান এবং অগ্রণী ব্যাংকের অপসারিত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ আবদুল হামিদসহ আটজনের বিরুদ্ধে দেওয়া অভিযোগপত্র অনুমোদন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

অভিযোগপত্র অনুযায়ী মুন গ্রুপের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান এক নম্বর আসামি। বাকি সব আসামিই অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তা। অন্য আসামিরা হলেন অগ্রণী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মিজানুর রহমান খান, সাবেক ডিএমডি মোফাজ্জল হোসেন, দুই উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) আখতারুল আলম ও আমিরুল ইসলাম, সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) মো. শফিউল্লাহ এবং সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার মো. রফিকুল ইসলাম।

দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে জানান, ‘অভিযোগপত্র এখন আদালতে দাখিল করা হবে। আদালত মামলা আমলে নিয়ে শুনানির তারিখ নির্ধারণ করবেন।’

অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রাজধানীর মতিঝিল থানায় ২০১৬ সালের ৩০ জুন মামলা হয়েছিল। অভিযোগপত্রে আসামিরা ৬০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

মুন গ্রুপের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, তিনি মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে অগ্রণী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। যে জমি বন্ধক রেখে তিনি ঋণ নেন, সেটি বিরোধপূর্ণ। ওই জমিতে ভবন তৈরির জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদিত নকশাও ছিল না। এ ছাড়া ঋণ নিয়ে ভবন তৈরিতে অস্বাভাবিক নির্মাণ ব্যয় দেখিয়েছেন মিজানুর রহমান। এসব কাজ করেছেন তিনি ব্যাংকের লোকদের যোগসাজশে।

দুদকের অভিযোগপত্র বলছে, আসামিরা প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গের অপরাধ করেছেন। যে জমি বন্ধক রেখে ঋণ দিয়েছে ব্যাংক, সেটি নিয়ে আদালতে কয়েকটি মামলা অমীমাংসিত ছিল। বিরোধপূর্ণ জমিতে ঋণের বন্দোবস্ত করে তাঁরা পরস্পর লাভবান হয়েছেন।

দুদক বলছে, ভবন নির্মাণে মুন গ্রুপের নামে ১০৮ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করা হয়। তবে ছাড় করা হয় ৯৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা। মিজানুর রহমান ৩৪ কোটি ৩০ লাখ ৮০ হাজার টাকায় এ ভবন নির্মাণ করেন। বাকি ৬০ কোটি ৪৯ লাখ ১৯ হাজার টাকা তিনি আত্মসাৎ করেন।

দুদকের মামলায় গত বছর মুন গ্রুপের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান, অগ্রণী ব্যাংকের ডিএমডি মিজানুর রহমান খান, ডিজিএম মো. আখতারুল আলম ও এজিএম মো. শফিউল্লাহ কয়েক মাস করে হাজত খেটে বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৬ সালের ৩০ জুন সৈয়দ আবদুল হামিদকে অপসারণ করার পর থেকে তাঁকে আর কোথাও দেখা যায়নি। তাঁর মোবাইল ফোনটি বন্ধ।

আসামি মোফাজ্জল হোসেন ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে জনতা ব্যাংকের পরিচালকের দায়িত্বে আছেন। প্রথম আলোর কাছে তিনি দাবি করেন, ঋণ কমিটির সুপারিশ ছাড়াই ওই ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করেছিল পর্ষদ। তিনি ঋণ কমিটিতে ছিলেন। তাই এর দায় তাঁর ওপর পড়বে না।

তবে দুদকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, ঋণ কমিটির সদস্য নয়, ব্যাংকের ডিএমডি হিসেবেই মোফাজ্জল হোসেন প্রধান শাখার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে এমডিকে দেন। এমডি পরে তা পর্ষদে উপস্থাপন করেন। দায়টা তাঁর এখানেই।

ঋণ অনুমোদনের সময়ে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষক খন্দকার বজলুল হক। আর পর্ষদে ছিলেন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা নাগিবুল ইসলাম, শাহজাদা মহিউদ্দিন, জাকির আহমেদ, আবদুস সবুর, শেখর দত্ত প্রমুখ। তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার।

দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের সময় টাকা ছাড়ের আগে ১৭টি শর্ত পরিপালন করতে বলেছিল পর্ষদ। ব্যাংক কর্মকর্তারা একটি শর্তও মানেননি।

ভবন নির্মাণের খরচের হিসাবের ব্যাখ্যা জানতে চাইলে দুদকের সূত্রগুলো জানায়, একটি বিশেষজ্ঞ দল মুন গ্রুপের এই ভবন ও এর নির্মাণসামগ্রী সরেজমিনে পরিদর্শন করে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। তাতে ৩৪ কোটি ৩০ লাখ ৮০ হাজার টাকার চিত্র উঠে এসেছে। মিজানুর রহমানকে রিমান্ডে নিয়েও বাকি ৬০ কোটি টাকার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।

যোগাযোগ করলে মুন গ্রুপের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ভবন তৈরিতে তাঁর খরচ হয়েছে ৩৭২ কোটি টাকা।

মিজানুর রহমান ঢাকার কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছাকাছি মিরপুর পাইকপাড়া মৌজার সিএস ও এসএ ৫৫৫ দাগের ৫২ শতাংশসহ মোট ১২০ শতাংশ জমি জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে দখল করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সেখানেই তিনি ঋণের টাকায় ২০ তলা ভবনের কাঠামো তৈরি করেন। জমির মালিক শেখ মো. জয়নাল আবেদিন ও জমির আমমোক্তার তাঁর ছেলে শেখ মো. আবদুল গণির করা একাধিক মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ২৭ নভেম্বর একটি মামলার শুনানি হওয়ার কথা।

জানতে চাইলে শেখ মো. আবদুল গণির আইনজীবী শফিকুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা জমির মূল কাগজপত্র আদালতে দাখিল করব। চাইব অপর পক্ষও তাদের কাগজপত্র আদালতে দাখিল করবে।’