আবদুল হাই বাচ্চুসহ পর্ষদ সদস্যদের ডেকেছে দুদক

শেষ পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু ও তাঁর নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পর্ষদকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধান শুরুর প্রায় চার বছর পর দুদক প্রথমবারের মতো তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নোটিশ দিয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের কয়েক দফা পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে দুদক এমন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে।

দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবদুল হাই বাচ্চুসহ পর্ষদের ১১ জনকে পর্যায়ক্রমে তলব করা হয়েছে। এর মধ্যে গত বুধবার দুদকে এসে বক্তব্য দিয়ে গেছেন দুজন। গতকাল বৃহস্পতিবার বক্তব্য দিয়েছেন আরেকজন।’

দুদক সূত্রে জানা গেছে, আগামী ৪ ডিসেম্বর জিজ্ঞাসাবাদে উপস্থিত থাকার জন্য আবদুল হাই বাচ্চুর বনানীর ডিওএইচএসের বাড়ির ঠিকানায় নোটিশ পাঠানো হয়েছে। ১৮ নভেম্বর এ নোটিশ পাঠানো হয়। পর্ষদের বাকি সদস্যদেরও ডাকা হয়েছে বিভিন্ন দিনে।

বুধবার বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য ও বর্তমানে ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব শ্যামসুন্দর সিকদার এবং আরেক সাবেক সদস্য ও বর্তমানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব কামরুন্নাহার আহমেদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আর গতকাল জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের শিক্ষক কাজী আখতার হোসেনকে।

শ্যামসুন্দর সিকদারের বক্তব্য নিতে গতকাল সচিবালয়ে গেলে তাঁর একান্ত সচিব জেসমিন পারভীন প্রথম আলোকে জানান, সচিব তাঁকে বলেছেন যে তিনি বেসিক ব্যাংক বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি নন।

দুদক সূত্র জানায়, যাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, তাঁরা বলেছেন যে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং এমডি তাঁদের পাত্তা দিতেন না। পর্ষদ সভা অনুষ্ঠানের নোটিশ জানানো হতো শেষ সময়ে যাতে পর্ষদে তাঁরা প্রস্তুতি নিয়ে না আসতে পারেন। চেয়ারম্যান কটু কথাও বলতেন তাঁদের। এমনও হয়েছে যে পর্ষদ সভা নির্ধারিত সময়ের আগেই শুরু হয়েছে এবং তাঁরা এসে দেখেন সভা শেষ।

জানা গেছে, দুদকের পক্ষ থেকে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য মো. আনোয়ারুল ইসলাম, এ কে এম কামরুল ইসলাম, সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলাম, বিসিকের তৎকালীন চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান, সাবেক কাস্টমস কমিশনার শাখাওয়াত হোসেন, উত্তরণ নামের একটি পত্রিকার সহকারী সম্পাদক আনিস মাহমুদ এবং চাঁদপুর চেম্বারের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জাহাঙ্গীর আকন্দ সেলিমকে নোটিশ পাঠানো হয়েছে।

আবদুল হাই বাচ্চুর নেতৃত্বাধীন পর্ষদ ২০১২ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৩ সালের মার্চ পর্যন্ত মাত্র ১১ মাসে নজিরবিহীন অনিয়মের মাধ্যমে ৩ হাজার ৪৯৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ঋণের নামে বিভিন্নজনকে দিয়ে দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংক তখন তদন্ত করে বলেছিল, ‘৪০টি দেশীয় তফসিলি ব্যাংকের কোনোটির ক্ষেত্রেই পর্ষদ কর্তৃক এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় না। এই ঋণ আদায়ের সম্ভাবনাও কম।’

বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে ২০১৫ সালের শেষ দিকে রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন ও গুলশান থানায় ১৫৬ জনকে আসামি করে ৫৬টি মামলা করে দুদক। এসব মামলায় বেসিক ব্যাংকের ২৭ কর্মকর্তা, ১১ জরিপকারী ও ৮১ ঋণ গ্রহণকারী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানসহ ১২৯ জনকে আসামি করা হয়। মামলাগুলো তদন্ত করছেন দুদকের ১০ কর্মকর্তা। তবে কোনো মামলাতেই আবদুল হাই বাচ্চুকে আসামি করা হয়নি। এ নিয়ে জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে অর্থনীতিবিদ, ব্যাংক খাতের বিশেষজ্ঞ এবং সর্বশেষ আদালত পর্যন্ত সমালোচনা করেন।

এত দিন পরে কেন আবদুল হাই বাচ্চুসহ বেসিক ব্যাংকের সাবেক পর্ষদ সদস্যদের তলব করা হলো, এমন প্রশ্নের জবাবে দুদকের প্রধান আইনজীবী খুরশীদ আলম খান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালতের নির্দেশে এ নোটিশ করা হয়েছে।’

আবদুল হাই বাচ্চু জিজ্ঞাসাবাদে না এলে দুদক কী করবে, এমন প্রশ্নের জবাবে খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘তখন দুদকের তদন্তে পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জানা গেছে, ২৭ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির একটি মামলার শুনানি আছে। ২৯ নভেম্বর রয়েছে হাইকোর্ট বিভাগে আরেকটি শুনানি। এসব শুনানিতে পর্ষদ সদস্যদের বিষয়ে দুদকের তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাওয়া হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ জুন পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৫৩ শতাংশ (৭ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা), যা যেকোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হারের চেয়ে বেশি।