সিরামিক খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে

দেশের সিরামিকশিল্প
দেশের সিরামিকশিল্প

তৈজসপত্র, স্যানিটারি ও টাইলস—এই তিন ধরনের সিরামিক পণ্যের চাহিদার বড় অংশই এখন পূরণ করছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান। তাই প্রতিবছরই এ খাতে নতুন বিনিয়োগ আসছে। দেশে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সিরামিক পণ্যের আমদানি কমছে। অন্যদিকে রপ্তানিও হচ্ছে। সব মিলিয়ে সিরামিক খাতে শক্ত ভিত তৈরি করে নিচ্ছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো।

সিরামিক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশে সিরামিক পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বিদেশেও আছে বড় বাজার। তবে সিরামিক পণ্য উৎপাদনের অন্যতম প্রধান কাঁচামাল গ্যাস-সংকটের কারণে পুরো খাত ধুঁকছে। অনেকের উৎপাদন প্রায় অর্ধেক কমে গেছে। তারপরও আগামী এপ্রিলে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আসবে সরকারের এমন আশ্বাসেই ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করছেন।

বাংলাদেশ সিরামিক পণ্য উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিসিএমইএ) জানায়, সিরামিক খাতে বর্তমানে ৬২টি প্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে তৈজসপত্রের ২০টি, টাইলসের ২৬টি ও স্যানিটারি পণ্য উৎপাদনের ১৬টি কারখানা। সিরামিক পণ্য উৎপাদনে মূল্য সংযোজন ৬৫ শতাংশ। সব মিলিয়ে সিরামিকশিল্পে ১০০ কোটি ডলার বা ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়েছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ খাতটির সঙ্গে জড়িত।

তৈজসপত্র উৎপাদনকারী ২৬ প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ কোটি পিস। তারাই তৈজসপত্রের দেশীয় চাহিদার ৮৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ পূরণ করে। ২৬টি টাইলস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান দেশীয় চাহিদার ৭২ দশমিক ২৯ শতাংশ জোগান দেয়। তাদের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ১২ কোটি বর্গমিটার টাইলস। স্যানিটারি পণ্যের দেশীয় চাহিদার ৮৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ পূরণ করছে ১৬টি স্যানিটারি পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। বাকিটা বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়।

জানতে চাইলে সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইরফান উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, দেশীয় প্রতিষ্ঠান উন্নতমানের সিরামিক পণ্য উৎপাদন করছে। দেশে প্রচুর চাহিদা থাকায় সিরামিক খাতে নতুন নতুন বিনিয়োগ আসছে। বর্তমানে প্রায় সাতটি প্রতিষ্ঠান কারখানা নির্মাণ করছে।

চলতি বছর গাজীপুরের মাওনায় দৈনিক ৪০ হাজার বর্গমিটার টাইলস উৎপাদন সক্ষমতা নিয়ে ডিবিএল সিরামিক কারখানা যাত্রা শুরু করে। এতে ৬০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। বর্তমানে সক্ষমতার অর্ধেক টাইলস উৎপাদন করে। এসব টাইলস দেশের বাজারে বিক্রি করলেও শিগগিরই টাইলস রপ্তানিতে যাবে তারা। এ ছাড়া টেকনিক্যাল সিরামিক পণ্য তৈরিতে গবেষণা করছে ডিবিএল।

জানতে চাইলে ডিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ জব্বার বলেন, ‘রপ্তানি বাজারকে টার্গেট করেই সিরামিক কারখানায় বিনিয়োগ করেছি। টাইলস উৎপাদনের পাশাপাশি টেকনিক্যাল সিরামিক পণ্য তৈরিতে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছি। এক বছর ধরে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটের জন্য যে সিরামিকের প্লেট দরকার হয়, সেটি তৈরিতে বুয়েটের সঙ্গে কাজ হচ্ছে। জ্যাকেটের জন্য বিশেষ ধরনের কাপড় বিদেশ থেকে আমদানি করা হবে। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশকে সেনাবাহিনীর জন্য বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট তৈরি করা হবে। সফল হলে জ্যাকেট বিদেশেও রপ্তানির পরিকল্পনা আছে।’

এম এ জব্বার বলেন, ‘সিরামিক পণ্যের কাঁচামাল বিদেশ থেকেই আমদানি করতে হয়। তবে ৩০ শতাংশ কাঁচামাল দেশীয় উপাদানে করা সম্ভব। সে জন্যও আমরা গবেষণা করছি।’

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে সিরামিক খাতের গোড়াপত্তন হয় ষাটের দশকে। প্রথমে এমসিআই ও ন্যাশনাল সিরামিক কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ঢাকা সিরামিক ও তাজমা সিরামিক কারখানা হয়। ১৯৬২ সালে যাত্রা শুরু করে পাকিস্তান সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ। স্বাধীনতার পর থেকে সেটি পিপলস সিরামিক নামে পরিচালিত হচ্ছে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) আওতায় মিরপুরে বাংলাদেশ ইনস্যুলেটর অ্যান্ড স্যানিটারিওয়্যার ফ্যাক্টরি (বিআইএসএফ) হয়।

বেসরকারি খাতে প্রথম কারখানা মুন্নু সিরামিক হয় ১৯৮৫ সালে। পরে আরও অনেক উদ্যোক্তা সিরামিক খাতে বিনিয়োগ করেন। উন্নতমানের সিরামিক পণ্য উৎপাদনে মুন্নু, শাইনপুকুর, পিপলস, ফার, প্রতীক, আরএকে, সিবিসি, স্ট্যান্ডার্ড, আবুল খায়ের, ইউরো বাংলা, চারু, মধুমতি, স্টার, প্যারাগনসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

বর্তমানে আমেরিকা, কানাডা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালিসহ বিশ্বের ৫০টির বেশি দেশে বাংলাদেশের সিরামিক পণ্যসামগ্রী রপ্তানি হচ্ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪ কোটি ১৮ লাখ কোটি ডলার বা ৩৩৮ কোটি টাকার সিরামিক পণ্য রপ্তানি করেছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। এই আয় আগের অর্থবছরের চেয়ে সাড়ে ১৪ শতাংশ বেশি। সিরামিক পণ্যের মধ্যে তৈজসপত্র বেশি রপ্তানি হচ্ছে। গত অর্থবছর ৩৩৮ কোটি টাকার রপ্তানির মধ্যে ছিল তৈজসপত্র ২৮৮ কোটি ও টাইলস ৫০ কোটি টাকার।

রপ্তানি বিষয়ে সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইরফান উদ্দিন বলেন, ‘সিরামিক পণ্য রপ্তানিতে নেতৃত্ব দেয় চীন। তবে শ্রমিকের খরচ বেড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে চীনের রপ্তানি কমছে। এ ছাড়া ২০১৩ সালের মে মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন চীনের সিরামিক পণ্যের ওপর পাঁচ বছরের জন্য অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করে। সেটির সুফল গত বছর থেকে আমরা পাচ্ছি। নতুন নতুন ক্রেতার ক্রয়াদেশ আসছে।’

১৯৮৫ সালে ধামরাইয়ে যাত্রা শুরু করা মুন্নু সিরামিক বছরে প্রায় এক কোটি পিস তৈজসপত্র উৎপাদন করে। গত অর্থবছর স্থানীয় বাজারে প্রায় ৬৫ কোটি টাকার তৈজসপত্র বিক্রি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। আর রপ্তানি করেছে ৯০ কোটি টাকার পণ্য। বর্তমানে মুন্নুর কারখানায় ৩ হাজার শ্রমিক কাজ করেন।

অবশ্য গ্যাসস্বল্পতার জন্য মুন্নুর উৎপাদন অর্ধেকে নেমে গেছে বলে জানালেন প্রতিষ্ঠানটির ভাইস চেয়ারম্যান মইনুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্যাসের বিল পুরোটা দিতে হচ্ছে। তবে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাচ্ছি না। সে জন্য উৎপাদন অর্ধেক কমে গেছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজজটের কারণে কাঁচামাল আমদানিতে খরচ বেড়ে গেছে।’

মইনুল ইসলাম আরও বলেন, ‘চীনের বাজার সংকুচিত হওয়ায় আমাদের ক্রয়াদেশ বাড়ছে। তবে গ্যাস-সংকট ও চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজজটের কারণে সুযোগটি কাজে লাগাতে পারছি না। তবে আমরা আশায় বুক বেঁধে আছি, আগামী বছর এলএনজি চলে এলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’

গ্যাস-সংকটের বিষয়ে ইরফান উদ্দিন বলেন, ‘গ্যাস সমস্যা একেক এলাকায় একেক রকম। গত ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গাজীপুরে ভয়াবহ গ্যাস-সংকট ছিল। তখন সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত আমরা উৎপাদন করতেই পারতাম না। চলতি মাসে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে গ্যাসের চাপ কম থাকায় প্রতিদিন ১০-১৫ শতাংশ পণ্যের মান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’