ব্যাংক একীভূত করার সময় এসেছে

আনিস এ খান
আনিস এ খান
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের ব্যাংক খাত বেশ আলোচিত হয়ে উঠেছে। ফারমার্স ব্যাংকে বড় অনিয়মের পরও নতুন ব্যাংক দেওয়ার উদ্যোগ, একের পর এক ব্যাংকে হঠাৎ পরিবর্তন এর প্রধান কারণ। এ ছাড়া বেসরকারি খাতে ঋণ যাচ্ছে অনেক বেশি, ডলারের বাজার আবারও চড়া হয়ে উঠেছে। ব্যাংক খাতের সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সানাউল্লাহ সাকিব

প্রথম আলো: কেমন চলছে দেশের ব্যাংক খাত। ব্যবসা কি আগের মতোই, নাকি কিছুটা বাড়ছে?

আনিস এ খান: ব্যাংক হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মেরুদণ্ড। যখন একটি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোর উন্নতি হয়, তখন ব্যাংকগুলোও ভালো চলে। এটা ব্যাংকের নিজস্ব অর্থ নয়, জনগণের কষ্টের সঞ্চয়ের অর্থ। ব্যাংকের প্রধান দায়িত্ব মানুষের সঞ্চয়কে রক্ষা করা। ব্যাংকের আমানতের ওপর যাতে কারও অনাস্থা তৈরি না হয়, তা নিশ্চিত করা ব্যাংকের প্রধান দায়িত্ব। এটা ঠিক থাকলেই ব্যাংক সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। ব্যাংকগুলো এখন বড় প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে। তবে বাংলাদেশে একটা প্রবণতা আছে, কোনো খাত ভালো করলে সবাই সেখানে ঝোঁকে। একসময় ট্রলার, সিমেন্ট কারখানায় বিনিয়োগ হয়েছে। বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই নিয়মিত পণ্য বিক্রি করতে পারছে না, ফলে ঋণের কিস্তিও শোধ হচ্ছে না।

প্রথম আলো: বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি দিয়েছিল ১৬ দশমিক ২ শতাংশ। গত অক্টোবরে তা ১৯ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে। কিন্তু দেশে তো বড় কোনো শিল্পায়নের খবর মিলছে না। তাহলে এত টাকা যাচ্ছে কোথায়?

আনিস এ খান: মুদ্রানীতিতে যে লক্ষ্য দেওয়া হয়, ঋণ তার কাছাকাছি থাকা উচিত। যখন দেখা যাচ্ছে ঋণ বেশি চলে যাচ্ছে, তখন তা বিশ্লেষণ করতে হবে। এত টাকা কোথায় গেল। এ বছর প্লাবন হওয়ায় অনেক খাদ্যশস্য আমদানি করতে হবে। আমদানি যে বেড়ে গেছে, এটাও অন্যতম কারণ। কারখানা করতে আগে যেসব মূলধনি যন্ত্র আনা হয়েছিল, তারা উৎপাদনে যাচ্ছে। কাঁচামাল আমদানি করছে তারাও। এ ছাড়া অনেকে কারখানা বাড়াচ্ছে, নিয়মকানুন মেনে নতুন কারখানা করছে। ডেনিম আগে আমদানি করে আনতে হতো, এখন নিজেরাই করছি। কিন্তু কাঁচামাল তো আমদানি করতে হচ্ছে। এ জন্য ঋণ বেড়ে গেছে।

প্রথম আলো: বৈদেশিক বাণিজ্য কেমন চলছে। আমদানি বাড়ছে, কমছে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। ডলারের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। কারণ কী?

আনিস এ খান: রপ্তানিতে একটু ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। তবে রপ্তানি বাড়াতে নতুন নতুন অঞ্চল করছে সরকার। যদিও বাংলাদেশের জন্য নতুন রপ্তানি বাজার পাওয়া কঠিন। আমাদের পোশাক রপ্তানিতেই বেশি জোর দিতে হবে, এ জন্য উচ্চ মানের পোশাক তৈরি করতে হবে। দেশীয় কারখানাগুলো কেবলই পরিবেশবান্ধব কারখানা হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। এখন নতুন নতুন দেশে রপ্তানি করতে হবে। পাট রপ্তানি করে আর কত আয় হবে। ওষুধ রপ্তানি করে আয় আসবে, তবে আরও সময় লাগবে। দেশের অর্থনীতি বড় হচ্ছে। ব্যাংকের সঙ্গে বড় শিল্প গ্রুপগুলোও এখন তহবিল নিয়ে কাজ করছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার এত নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলবে না। নীতিনির্ধারকদের এ নিয়ে বসা প্রয়োজন। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ডলারের দাম ৮০-৮৫ টাকার মধ্যে ওঠানামা করলে কোনো সমস্যা দেখি না।

প্রথম আলো: নতুন একটি ব্যাংক তো ব্যর্থ হওয়ার পথে। এরপরও নতুন করে ব্যাংক দেওয়ার পরিস্থিতি আছে কি?

আনিস এ খান: ব্যাংকের সংখ্যা এমনিতেই অনেক হয়ে গেছে। নতুন ব্যাংক আসতে পারে, তবে একটা নির্দিষ্ট সময় পর এলে ভালো হয়। কারণ, ব্যাংক ব্যবসার বাজার সেভাবে বাড়ছে না। নতুন ব্যাংক এলে পুরোনো ব্যাংক থেকেই কর্মী, ব্যবসা নিয়ে যায়। ফলে সব ব্যাংকই দুর্বল হয়ে পড়ে। ব্যাংকে জনবল তৈরি করতে সময় লাগে। তা ছাড়া ৫৭ ব্যাংক তো দেশের জন্য কম নয়। এখন ব্যাংক একীভূত বা অধিগ্রহণ করার সময় এসেছে। ব্যাংক এশিয়া, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড দুটোই অধিগ্রহণ করে ভালো করছে, শক্তিশালী অবস্থানে চলে গেছে। এ নিয়ে পৃথক আইন করার সময় এসেছে। নতুন যে ব্যাংকটি খারাপ হয়েছে, তা মূলত সুশাসনে ব্যর্থতার ফল। পরিচালকেরা নিজেরাই ব্যাংক পরিচালনা করেছেন, ঋণ দিয়েছেন। পেশাদার কোনো ব্যবস্থাপনা ছিল না ব্যাংকটিতে।

প্রথম আলো: খেলাপি ঋণ তো বাড়ছেই। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না কেন?

আনিস এ খান: হ্যাঁ সত্যিই, খেলাপি ঋণ কমাতে পারছি না আমরা। পুনর্গঠন করেও ঋণ নিয়মিত রাখা যাচ্ছে না, এটা আমাদের ব্যর্থতা। যেসব ঋণ নিয়মিত করা হয়েছিল, তাদের অনেকেই ঋণ নিয়মিত রাখতে পারছে না। খেলাপি ঋণ কমানোই এখন ব্যাংকগুলোর প্রধান চ্যালেঞ্জ।

প্রথম আলো: ব্যাংকগুলোতে হঠাৎ পরিবর্তনের একটা প্রবণতা শুরু হয়েছে। কীভাবে দেখছেন বিষয়টিকে?

আনিস এ খান: পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন পরিবর্তন হয়। তবে আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ও চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এটি। কোনো সময় কোনো ব্যাংকে এমন পরিবর্তন হয়। আমাদের সহকর্মী এমডিরা হঠাৎই চাকরি হারাচ্ছেন। পেশাদার দুজন ব্যাংকার বসে আছেন। এতে আমরা ব্যথিত। এর বেশি কিছু বলার সুযোগ নেই।