বোতামের সম্ভাবনা বাড়ছে

শার্ট তৈরি করলে বোতাম লাগবেই। কেবল শার্ট নয়, পলো টি-শার্ট, প্যান্টসহ বিভিন্ন পোশাকেই বোতামের প্রয়োজন হয়। ফলে তৈরি পোশাকের সঙ্গে প্রচ্ছন্নভাবে বোতামের রপ্তানিও বাড়ছে। সেই বোতামের একটি বড় অংশ তৈরি হচ্ছে দেশীয় কারখানায়। 

ব্যবসায়ীরা বলছেন, রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানার বোতামের চাহিদার ৮০ শতাংশই পূরণ করছে দেশে তৈরি বোতাম। ফলে এ খাতে নতুন বিনিয়োগ আসছে। পুরোনো কারখানাও সম্প্রসারিত হচ্ছে। তবে সম্ভাবনার পাশাপাশি চ্যালেঞ্জ আছে। কিছু কারখানা টিকে থাকতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে।
পোশাকশিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় ৩৫টি সরঞ্জামের একটি বোতাম। দেশে বর্তমানে ৫০ থেকে ৫৫টি বোতাম তৈরির কারখানা আছে। ছোট আকারের একটি বোতাম কারখানা তৈরিতে খরচ হয় ৪ থেকে ৫ কোটি টাকা। মাঝারি আকারের কারখানার জন্য লাগে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে বোতাম তৈরির কারখানায় বর্তমানে এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে।
আশির দশকের মধ্যভাগে স্থানীয় কারখানাগুলোতে বোতাম সরবরাহের জন্য মেজর জব্বার নামের একজন উদ্যোক্তা ‘বাটন কিং’ নামের একটি কারখানা স্থাপন করেন। তবে রপ্তানিমুখী আধুনিক বোতাম প্রস্তুতকারী কারখানা বলতে যা বোঝায়, সেটির যাত্রা শুরু হয় ইফতেখার আহমেদের হাত ধরে। ১৯৯৫ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইন্টারলিংক এক্সেসরিজ লিমিটেড’। একই বছর বোতাম উৎপাদন শুরু করে ডেকো এক্সেসরিজ লিমিটেড।
বর্তমান ডেকো প্রতি মাসে ৯০ হাজার জিজি (গ্র্যান্ড গ্রস) প্লাস্টিকের বোতাম তৈরি করে। এক জিজির প্যাকেটে ১ হাজার ৭২৮টি বোতাম থাকে। ব্যাপক চাহিদা থাকায় ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি ধাতুর বোতাম উৎপাদন শুরু করে। প্রতি মাসে ৩৬ লাখ ডজন ধাতুর বোতাম তৈরি করছে। এসব বোতামের ৬ থেকে ৮ শতাংশ ডেকোর নিজস্ব রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা ও বাকিটা অন্যান্য পোশাক কারখানার মাধ্যমে প্রচ্ছন্নভাবে রপ্তানি হয়।
এসব তথ্য দিয়ে ডেকোর জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক খান মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবছরই বোতামের চাহিদা বাড়ছে। ফলে প্রতিবছরই বিনিয়োগ করছি আমরা।’ তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কাঁচামাল আমদানিতে সমস্যা পোহাতে হয়। প্রায়ই সঠিক সময়ে কাঁচামাল কারখানায় পৌঁছানো যাচ্ছে না। এতে নির্দিষ্ট সময়ে ক্রেতাকে পণ্য সরবরাহ করা যায় না।
বোতাম তৈরিতে আরেক বড় প্রতিষ্ঠান ইমপ্রেস এক্সেসরিজ লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় এক দশক আগে বোতাম তৈরি শুরু করে। বর্তমানে সব ধরনের প্লাস্টিকের বোতাম প্রস্তুত করছে। তাদের মাসিক উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ৫০ হাজার জিজি বোতাম।
জানতে চাইলে ইমপ্রেস এক্সেসরিজ লিমিটেডের পরিচালক খন্দকার নাজিরুজ্জামান বলেন, বর্তমানে প্রচুর পরিমাণে চীনা বোতাম দেশে আসে। ফলে বোতামে বিনিয়োগের সুযোগ আছে। তবে এটিও সত্য অনেক কারখানা কারিগরি সমস্যার কারণে টিকতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা পেলে পোশাকশিল্পে আরও বেশি মূল্য সংযোজন করতে পারবে বোতাম খাত।
উদ্যোক্তারা জানান, প্লাস্টিকের বোতাম তৈরির মূল কাঁচামাল হলো রেজিন। উপকরণটি সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান ও দুবাই থেকে আমদানি করা হয়। যন্ত্রে প্রক্রিয়াকরণের মধ্য দিয়ে বোতাম তৈরি হয়। একটি যন্ত্রে প্রতি মিনিটে ১০০ থেকে ১২০টি বোতাম তৈরি হয়। আর ধাতুর বোতামের জন্য শিট তাইওয়ান ও চীন থেকে আমদানি করা হয়।
৩৫টি বোতাম কারখানা বাংলাদেশ গার্মেন্টস এক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএপিএমইএ) সদস্য। এর মধ্যে চলতি বছর ৩টি নতুন কারখানা সমিতির সদস্য হয়েছে। সমিতির সভাপতি আবদুল কাদের খান বলেন, গত অর্থবছর ২ হাজার ৮১৪ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। এর মধ্যে বোতাম, লেবেল, প্রাইজ ট্যাগ, হ্যান্ড ট্যাগ জিপার, কার্টনসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম ছিল ৬৭০ কোটি ডলারের।
আবদুল কাদের খান বলেন, বোতামসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম তৈরির জন্য ছোট ও মাঝারি আকারের পর্যাপ্ত কারখানা আছে। তারপরও ৫০ লাখ থেকে ২ কোটি টাকা বিনিয়োগে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো কারখানা নেই। কিন্তু তারাই বিভিন্ন বিদেশি ক্রয়াদেশ পাচ্ছে। পরে সেই কাজ দেশীয় কারখানার মাধ্যমে করিয়ে মাঝখান থেকে মোটা অঙ্কের মুনাফা নিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে শক্ত হওয়া দরকার। কম মূলধনের বিদেশি বিনিয়োগ অনুমোদন দেওয়া উচিত নয়।
আবদুল কাদের খান আরও বলেন, ‘পোশাক খাতের কর্মপরিবেশ উন্নয়নে অনেক কাজ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরঞ্জাম উৎপাদনকারী কারখানাগুলো পিছিয়ে আছে। ক্রেতাদের কাছ থেকে ইতিমধ্যে এসব কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নে চাপ আসছে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া দরকার। তা না হলে প্রতিযোগিতায় আমরা পিছিয়ে পড়ব।’
বিজিএপিএমইএর অনেক সদস্যই বোতাম প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতিরও সদস্য। ২০১৩ সালে এই সমিতির সদস্য ছিল ১৮। চলতি বছর সেটি বেড়ে ৪২ হয়েছে। সমিতির সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমীন বলেন, ‘বিদেশি কিছু প্রতিষ্ঠান বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে বোতামের ক্রয়াদেশ নিয়ে নেয়। তারপর আমাদের কারখানা থেকে পণ্য উৎপাদন করে। এতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। বিষয়টি নিয়ে পোশাকমালিকদের সোচ্চার হতে হবে।’
সমিতির আরেক সদস্য নাম প্রকাশ না শর্তে বলেন, ক্রয়াদেশ অনুযায়ী বোতাম সরবরাহ করেও অনেক পোশাক কারখানা থেকে সময়মতো অর্থ পাওয়া যায় না। সে জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া কিছু অসাধু কাস্টমস ও বন্ডের কর্মকর্তার জন্য ব্যবসার খরচ বাড়ছে। সব মিলিয়ে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের টিকে থাকা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।