রাষ্ট্রায়ত্ত মিলের পাট কেনায় দুর্নীতি হচ্ছে

>বছরের পর বছর লোকসান গুনছে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল। অবস্থা এতটাই খারাপ হয়েছে যে পাটকলগুলো শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ করতে পারছে না। বকেয়া মজুরির দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন শ্রমিকেরা। সাত দিন ধরে খুলনার আট পাটকলের উৎপাদন বন্ধ। এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ পরিষদের কার্যকরী আহ্বায়ক মো. সোহরাব হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শুভংকর কর্মকার ও শেখ আল-এহসান
মো. সোহরাব হোসেন
মো. সোহরাব হোসেন

প্রথম আলো: হঠাৎ করে পাটকলশ্রমিকেরা কঠোর আন্দোলনে নামলেন কেন? আগেও তো পাটকলগুলোতে বেশ কয়েকবার সাপ্তাহিক 

মজুরি বকেয়া পড়েছিল। তখন শ্রমিকেরা এতটা কঠোর হননি। 

সোহরাব হোসেন: আগেও বহুবার শ্রমিকের মজুরি বকেয়া পড়েছিল। আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে কর্তৃপক্ষ সেগুলো পরিশোধে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে মজুরি বকেয়া থাকছে। একটি পাটকলে ১২ সপ্তাহের মজুরি বাকি আছে। কয়েকটিতে আট-নয় সপ্তাহের। শ্রমিকেরা যে মজুরি পান, তা দিয়ে বর্তমান বাজারে চলতে কষ্ট হয়। তারপর সেই মজুরিও না পেলে বাধ্য হয়েই আন্দোলনে নামেন শ্রমিকেরা। গত বৃহস্পতিবার (২৮ ডিসেম্বর) যদি চলতি মজুরি দেওয়া হতো, তাহলে পাটকলগুলো বন্ধ হতো না। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বিভিন্ন পাটকলের পাটপণ্য বিজেএমসির মাধ্যমে সুদানে রপ্তানি করেছে গোল্ডেন ফাইবার নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এ জন্য গত নভেম্বরে সেই প্রতিষ্ঠানটি বিজেএমসির সঙ্গে চুক্তি করে। তখন বিজেএমসির চেয়ারম্যান আশ্বাস দিয়েছিলেন, রপ্তানির টাকা পেলেই শ্রমিকদের বকেয়া দেবেন। গত ১১ ডিসেম্বর বিষয়টি নিয়ে পাট শ্রমিক লীগের সঙ্গে চেয়ারম্যানের একটি চুক্তি হয়। তবে সম্প্রতি বিজেএমসি থেকে পাটকলগুলোতে একটি চিঠি আসে। সেখানে নির্দেশনা ছিল, রপ্তানির টাকা এলে যন্ত্রপাতি ও গ্র্যাচুইটির বকেয়া অর্থের ৫০ শতাংশ এবং কাঁচা পাটের বকেয়া ৭০ শতাংশ পরিশোধ করতে হবে। সেখানে মজুরি, বেতন ও বকেয়ার কথা বলা ছিল না। সেই চিঠি শ্রমিকদের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।

প্রথম আলো: বকেয়া মজুরি পরিশোধ, মজুরি কমিশন বাস্তবায়নসহ ১১ দফা দাবিতে আন্দোলন করছেন আপনারা। মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন হলে তো মজুরি বাড়বে। তখন কী অবস্থা হবে। এখনই তো পাটকলগুলো মজুরি দিতে পারছে না।

সোহরাব হোসেন: সরকার অনেক খাতে ভর্তুকি দেয়। আমরা পাটকে কৃষিভিত্তিক শিল্প করার দাবি করেছিলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালে পাট দিবসে সেই ঘোষণা দিয়েছেন। তবে কৃষকেরা যে ভর্তুকি পান, সেটি আমরা পাচ্ছি না। সেটির ব্যবস্থা করতে হবে। মজুরি কমিশন বাস্তবায়িত হলে যে মজুরি বাড়বে, সে জন্য ভর্তুকি দেওয়া হোক। এ ছাড়া কাঁচা পাট ও যন্ত্রপাতির কেনার জন্য পাট মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি অর্থবছরের বাজেটেই বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন।

প্রথম আলো: পাটকলগুলো সরকারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। তাহলে কেন ভর্তুকি লাগবে? মিলগুলো নিজের আয়ে চলতে পারবে না কেন?

সোহরাব হোসেন: সরকারের অনেক লোকসানি খাত আছে। তার মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল একটি খাত। এগুলো সরকারের ভর্তুকি দিয়েই চালাতে হবে।

প্রথম আলো: বেসরকারি পাটকলগুলো তো লাভজনক। তাহলে কেন রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল লাভজনক হবে না। সমস্যা কোথায়?

সোহরাব হোসেন: বেসরকারি খাতের পাটকলে শ্রমিকের মজুরি কম। বিশ্বের অনেক দেশই রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ভর্তুকি দিয়ে চালায়। দেশের শ্রমিকেরা ভালোভাবে থাকবেন, সেই উদ্দেশ্য নিয়েই কিন্তু বঙ্গবন্ধু পাটকলগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত করেছিলেন। তখন থেকেই ভর্তুকি দিয়ে আসছে সরকার।

 প্রথম আলো: আপনি বলতে চাইছেন, ভর্তুকি দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই?

সোহরাব হোসেন: থাকবে না কেন? রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো লাভজনক হোক, সেটি আমরা চাই। তবে পাটের মৌসুমে পাট ক্রয় নিয়ে দুর্নীতি হচ্ছে। কোনো জবাবদিহি নেই। আমরা বারবার বলে আসছি, পাটের মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে বাজারদর অনুযায়ী পাট কেনা হোক। কিন্তু বিজেএমসি পাট কেনে না। সেই পাট যখন কৃষকের কাছ থেকে শিপারদের কাছে চলে যায়, তখন দাম বাড়ে। আর তখনই পাট কেনা শুরু করে বিজেএমসি। মূলত বিজেএমসির কিছু অসাধু কর্মকর্তার কৌশলের কারণে এমনটা হচ্ছে। তাঁরা নিজেরা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া ও পাটকলগুলো ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। ক্রিসেন্ট জুট মিলে বছরে সাত লাখ মেট্রিক টন কাঁচা পাটের প্রয়োজন হয়। কেবল পাট কিনতে গিয়েই সেখানে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার লোকসান হচ্ছে খামোখা। আগে কৃষকের কাছ থেকে দেখেশুনে পাট কেনার নিয়ম ছিল। এখন বেল আকারে পাট কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু বেল করার ক্ষমতা সবার নেই। যাঁরা শিপার ও রপ্তানি করেন, তাঁরাই পারেন। ফলে ক্ষুদ্র পাট ব্যবসায়ীরা বর্তমানে সুযোগ পাচ্ছেন না। আবার সেই বেলের ভেতর যে মানের পাট দেওয়ার কথা, অনেক ক্ষেত্রেই সেটি দেন না ব্যবসায়ীরা। যাচাই-বাছাই করার সুযোগ থাকে না। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মিল। বেশ কিছু পণ্য মোড়কীকরণে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে বাস্তবে কি হচ্ছে? পাটপণ্য গুদামে পড়ে আছে। বিক্রি নেই। কারণ বস্তার দাম ৫৫ টাকা। সেটি কিনতে হলে আবার বিজেএমসির সঙ্গে চুক্তি করতে হবে। অন্যদিকে বেসরকারি মিলের বস্তার দাম ৪০ টাকা। যত অনিয়ম-দুর্নীতি আছে, সব বিজেএমসির কর্মকর্তাদের মধ্যে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত তৃণমূলের কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে বিজেএমসির বিভিন্ন পদে যেতেন। বর্তমানে সেখানে আধিপত্য কেবল আমলাদের। তাঁরা পাট চেনেন না, পাটকল চেনেন না। ওপর থেকে খালি অর্ডার দেবেন। অনভিজ্ঞতার কারণেই লোকসান হচ্ছে।

প্রথম আলো: বিজেএমসির কর্মকর্তারা লোকসানের কারণ হিসেবে সব সময় শ্রমিকের মজুরি ও সংখ্যা বেশি হওয়াকে দায়ী করেন। বিষয়টি কতটুকু সত্য?

সোহরাব হোসেন: সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। তাঁরা কিছু জানেন না, মুখস্থ কথা বলেন। ২০১০-১১ অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো লাভ করেছিল। তখন তো শ্রমিকের সংখ্যা বেশি ছিল। বর্তমানে যাঁরা অবসরে যাচ্ছেন, তাঁদের জায়গায় বদলি শ্রমিকদের স্থায়ী করা হচ্ছে না। সে জন্য বদলি শ্রমিকেরা রিকশা, ভ্যান, ইজিবাইক চালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন।

প্রথম আলো: সিবিএর কারণেও পাটকলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। আপনার বক্তব্য কী?

সোহরাব হোসেন: সিবিএর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সম্মানীয় ব্যক্তি। শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে তাঁদের কথা বলতে হয়। তাই তাঁরা কারখানায় কাজ করতে পারেন না। বাকি নেতারা কাজ করেন। সিবিএর নেতার নাম করে ১০ জন শ্রমিক কাজ না করে হাজিরা দিয়ে মজুরি নেন—এমনটা কেউ প্রমাণ করতে পারলে ট্রেড ইউনিয়ন করা বন্ধ করে দেব। উল্টো মিলের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা শ্রমিকদের দিয়ে বাসার বাজার পর্যন্ত করান। এতে উৎপাদন ব্যাহত হয়।