চিনিকলে এক যুগে লোকসান ২১৭ কোটি টাকা

এক যুগ ধরে লোকসান গুনছে পঞ্চগড় চিনিকল লিমিটেড। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, যান্ত্রিক ত্রুটি ও বিপুল পরিমাণ চিনি অবিক্রীত থাকাসহ নানা সমস্যার কারণে এ অবস্থা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। এ কারণে আর্থিক সংকটে পড়ে কলটির কর্মচারী ও শ্রমিকেরা ঠিকমতো বেতন পাচ্ছেন না।

পঞ্চগড়ে প্রতিবছর আখের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। আখের স্বল্পতার কারণে প্রতিবছর মাত্র দুই মাসেই বন্ধ হয়ে যায় কলটির চিনি উৎপাদন। সব মিলিয়ে গত ১২ বছরে এ প্রতিষ্ঠানের লোকসান ২১৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
কলটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনুর রেজা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যে আখ পাই, তা দিয়ে মিলটিকে ১২ মাস চালু রাখা সম্ভব নয়। তাই মিলটিকে বহুমুখী করতে মিনারেল ওয়াটার, ইলেকট্রিক পোল ও স্লিপার নির্মাণ এবং টমেটোর সস উৎপাদন করার জন্য প্রাথমিক প্রস্তাব পাঠিয়েছি চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনে। মিলটিকে বহুমুখী করা হলে এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।’
চিনিকল সূত্রে জানা যায়, ১৯৬৫ সালে পঞ্চগড়ের ধাক্কামারা এলাকায় ৫ কোটি ৫৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে ১৯৮ দশমিক ৪৬ একর জমিতে স্থাপিত হয় চিনিকলটি। ১৯৬৯ সাল থেকে পরীক্ষামূলকভাবে চিনি উৎপাদন শুরু হয়। কলটির উৎপাদনক্ষমতা ১০ হাজার টন। স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ৮ হাজার ৫৩৬ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদিত হতো এখানে। ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ৬১২ টন চিনি উৎপাদিত হয়। সর্বশেষ ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ৯ কোটি ৪১ লাখ ১৮ হাজার টাকা মুনাফা হয় এ কল থেকে। এরপর থেকেই লোকসান।
সূত্র আরও জানায়, ২০০৬-০৭ অর্থবছরে কলটিতে লোকসান হয় ৩৮ লাখ ৫৪ হাজার, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ৭ কোটি ৫৬ লাখ ৪৩ হাজার, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ১২ কোটি ২২ লাখ ১১ হাজার, ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১০ কোটি ২৬ লাখ ৯২ হাজার, ২০১০-১১ অর্থবছরে ১৬ কোটি ৭০ লাখ ১৫ হাজার, ২০১১-১২ অর্থবছরে ১৯ কোটি ৬৮ লাখ ১১ হাজার, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২২ কোটি ২৮ লাখ ২৯ হাজার, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৩০ কোটি ৫৮ লাখ ৬ হাজার, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩৬ কোটি ৭৭ লাখ ৫৬ হাজার, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩০ কোটি ৬৯ লাখ ৭৪ হাজার ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩০ কোটি ৩৪ লাখ ৬৩ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে। অর্থাৎ গত ১২ বছরে মোট লোকসান হয়েছে ২১৭ কোটি ৫০ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরেও লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে চলছে কলটি।
কলটির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় সাড়ে সাত শ শ্রমিক-কর্মচারী। তাঁদের কেউ স্থায়ী, আবার কেউ সাময়িক চুক্তিতে কাজ করেন। এখানকার শ্রমিক আবদুর রহিম বলেন, লোকসানের কারণে তাঁরা ঠিকমতো বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। কলটিকে বহুমুখী না করলে এই সংকট কাটবে না।
আখচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পঞ্চগড়ের আখ চাষ উপযোগী জমি ৩০ হাজার একর। এবার আখ চাষ হয়েছে ৫ হাজার ১৬ একর জমিতে। কিন্তু পুরোনো জাতের আখে চিনি উৎপাদন ব্যাপক হারে কমেছে। সেই সঙ্গে আখ চাষে লোকসান হওয়ায় চাষিরা অন্য ফসল চাষের দিকে ঝুঁকছেন। ৬০ টাকা দরে চিনি বিক্রির বিপরীতে কলে এক কেজি চিনির উৎপাদন খরচ পড়ে ১৫০ টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে কলটিতে ৩ হাজার ৬০০ টন চিনি অবিক্রীত অবস্থায় গুদামে মজুত রয়েছে। এর বাজারমূল্য প্রায় ২১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। চলতি মৌসুমে ৮৬ হাজার ৪০৫ টন আখ মাড়াই করে ৬ হাজার ৪৮ টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। চলতি মৌসুমে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত ২৬ হাজার ২৯৫ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে এক হাজার ৪১৭ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন করা হয়েছে।
সদর উপজেলার চাকলাহাট এলাকার আনিস প্রধান বলেন, ‘কল কর্তৃপক্ষ আখ কিনছে প্রতি মণ ১৩৫ টাকা ৩৬ পয়সায়। প্রতি বিঘা জমিতে আখ উৎপাদনে খরচ হয় ২৫ হাজার টাকা। আর আখ পাওয়া যায় ২০০ থেকে ২৫০ মণ। উৎপাদন ও পরিবহন খরচ দিয়ে আমাদের আসল টেকানোই কষ্ট হয়ে যায়। আখের দাম না বাড়ালে আমাদের মতো কৃষকদের অন্য ফসল চাষ করতে হবে।’ একই ধরনের কথা বলেন টুনিরহাট এলাকার আখচাষি জব্বারুল ইসলাম।
জানতে চাইলে শাহনুর রেজা বলেন, ‘আখের স্বল্পতাসহ বেশ কিছু সমস্যার কারণে মিলে লোকসান হচ্ছে। এ ছাড়া বাজারে প্রাইভেট কোম্পানির বিষাক্ত রিফাইন চিনি ৫৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এতে আমাদের চিনি বিক্রি হচ্ছে না। শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে সমস্যা হচ্ছে। তবে আমরা আখ চাষ বাড়াতে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছি। চিনিকলের শ্রমিক ও কর্মচারীদের আখ চাষ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ ছাড়া চাষিদের ঋণ সহায়তা, সার ও কীটনাশক বিতরণ এবং কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে উঠান বৈঠক ও কৃষক সমাবেশ করা হচ্ছে।’