সচল মুদ্রা, অচল মুদ্রা

বাঙালি জীবনে ‘পয়সা’ এতই প্রচলিত শব্দ যে কোটি টাকা বোঝাতেও পয়সার ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন ভাগনে তার মামাকে বলছে, মামা, গুলশানে একটা ফ্ল্যাট আছে। আমার এক বন্ধুর বাবার। বেচে দেবেন। খুবই সস্তা। ১ কোটি ২০ লাখ টাকা দাম। জবাবে মামা বললেন, না রে, অত পয়সা নেই। খাইয়া ফালাইছে সব শেয়ারবাজারে।

একটু খোঁজ নেওয়া যাক এই পয়সার বাস্তব অবস্থাটা কী? বাংলাদেশ হওয়ার পর এখন পর্যন্ত ধাতব মুদ্রা বা পয়সাই-বা চালু হয়েছে কয়টি, কী ধরনের?

দেশে বর্তমানে পয়সা আকারে ধাতব মুদ্রা চালু আছে ১, ৫, ১০, ২৫ ও ৫০ পয়সার। এ ছাড়া ১ টাকা, ২ টাকা ও ৫ টাকার ধাতব মুদ্রাও আছে। কিন্তু দৈনন্দিন কেনাকাটা বা লেনদেনে ১, ৫, ১০ ও ২৫ পয়সার ধাতব মুদ্রার ব্যবহার হয় না এখন। ৫০ পয়সার ব্যবহার মাঝে মাঝে দেখা গেলেও অন্য চার ধরনের পয়সাই কার্যত অচল। বাস্তব জীবনে কাজে না লাগা এসব পয়সা আইনগতভাবে সচল। অর্থাৎ সচল মুদ্রা বাস্তবে অচল।

আরেকটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হতে পারে। ব্যাংক হিসাবে বা কাগজপত্রের হিসাবে এখনো পয়সার অঙ্ক লেখা হয়। যেমন কেউ হয়তো ৭ শতাংশ সুদে এক লাখ টাকার স্থায়ী আমানত (এফডিআর) রাখলেন ব্যাংকে। জরুরি প্রয়োজনে ব্যাংক থেকে এফডিআর ভাঙাতে গিয়ে জানলেন, তিনি পাবেন ১ লাখ ৪ হাজার ৫০৯ টাকা ২২ পয়সা। বাস্তবে পুরো টাকা পেলেও ব্যাংক ওই আমানতকারীকে ২২ পয়সা দেবে না, এমনকি আমানতকারী ওই পয়সার আশাও করেন না। আর লেনদেনে ব্যবহার না হতে হতে পয়সাগুলোর জায়গা হয়েছে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে।

আইনত সচল, কিন্তু বাস্তবে অচল পয়সাগুলোর এই অবস্থার নেতিবাচক একটি দিকের কথা জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘একটা বিস্কুটের দাম ছিল ২ টাকা। ২০ শতাংশ বাড়লে দাম হবে ২ টাকা ৪০ পয়সা। কিন্তু ৩ টাকা দিলে দোকানদারের পক্ষে ৬০ পয়সা ফেরত দেওয়ার বাস্তবতা না থাকায় ক্রেতাকে ৩ টাকাই দিয়ে আসতে হয়।’

একাধিক জ্যেষ্ঠ নাগরিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিছুদিন পাকিস্তানি মুদ্রায় লেনদেন হয়েছে। বাংলাদেশ কয়েনেজ অর্ডার, ১৯৭২ হওয়ার পরের বছর ১৯৭৩ সাল থেকে বিভিন্ন মূল্যমানের ধাতব মুদ্রা ছাড়তে শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এসব মুদ্রার গায়ে তখন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ স্বপ্নের কথাও লেখা থাকত। যেমন এক টাকার মুদ্রার গায়ে লেখা ছিল পরিবার পরিকল্পনার স্লোগান। দুই সন্তানসহ চার সদস্যের ছবি যা সুখী পরিবারের প্রতিচ্ছবি। আবার অর্থনীতির প্রাণ বোঝাতে কোনো মুদ্রায় থাকত কৃষকের লাঙল আর কারখানার চাকার ছবি। আবার কোনো কোনো পয়সার গায়ে ছিল গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা করার প্রতীক। ছিল কবুতর, মাছ, মুরগি, ডিম, আনারস আর কলার মতো পুষ্টিকর খাদ্যপণ্যের ছবিও।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, প্রথম ধাতব মুদ্রা হিসেবে ৫ পয়সা ও ১০ পয়সা চালু হয় ১৯৭৩ সালে। ১ পয়সার মুদ্রা চালু হয় তারপরের বছর, ১৯৭৪ সালে। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কম মূল্যমানের এবং সবচেয়ে ছোট আকৃতির ধাতব মুদ্রা এই ১ পয়সা। অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি গোলাকার এই মুদ্রায় ছিল জাতীয় ফুল শাপলা।

আর ৫ পয়সার মুদ্রাটি ছিল চার কোনাবিশিষ্ট অ্যালুমিনিয়ামের। এর এক পাশে লাঙল ও চাকা এবং অন্য পাশে ছিল শাপলা ফুলের ছবি। ১০ পয়সার মুদ্রাটি করা হয় আট কোনাবিশিষ্ট। এর এক পাশে ছিল পান পাতা এবং অন্য পাশে শাপলা ফুল।

২৫ ও ৫০ পয়সার মুদ্রায় ছিল রুই মাছ, জাতীয় ফুল শাপলা, মাছ, কলা, ডিম, লাউ ও বেঙ্গল টাইগার। পরে ইলিশ মাছ, মুরগি, কলা ও আনারসের ছবিও দেওয়া হয়।

পয়সার পাশাপাশি ১, ২ ও ৫ টাকার মুদ্রাও চালু করা হয়। ১ পয়সা থেকে ২ টাকা পর্যন্ত মুদ্রাগুলো এত দিন সরকারি মুদ্রা হিসেবে প্রচলিত ছিল। আইন সংশোধন করে ২০১৬ সালের মাঝামাঝি ৫ টাকাকেও সরকারি মুদ্রা ঘোষণা করে সরকার।

বিশ্বজুড়েই ব্যাংক মুদ্রা ও সরকারি মুদ্রা—এ দুই আকারে মুদ্রা চালু থাকে। বাংলাদেশেও তাই রয়েছে। ব্যাংক নোট বা ব্যাংক মুদ্রার মধ্যে বর্তমানে বাজারে রয়েছে ১০, ২০, ৫০, ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকা মূল্যমানের নোট। এগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক বের করে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের মে মাস পর্যন্ত দেশে ৯৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা মূল্যমানের কাগুজে নোট ও ধাতব মুদ্রা প্রচলিত রয়েছে। দেশের মোট সম্পদ যা-ই থাকুক না কেন, মানুষ লেনদেন করে এই মুদ্রাগুলো নিয়েই। অচল এক পয়সা থেকে এক হাজার টাকার নোট পর্যন্ত সব মুদ্রাই রয়েছে এই ৯৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকার মধ্যে।

২০১৬ সালের মে পর্যন্ত মোট মুদ্রার মধ্যে ব্যাংক নোটের মূল্যমান ৯২ হাজার ৩৫৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা। আর সরকারি মুদ্রার মূল্যমান হচ্ছে ৭৯৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। বাজারে প্রচলিত মোট মুদ্রার মধ্যে ব্যাংক মুদ্রার অংশ হচ্ছে ৯৯ শতাংশের মতো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য বিদায়ী নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, আইন অনুযায়ী কোনো পয়সাই অচল নয়। বাজারে কেনাকাটার ক্ষেত্রে পয়সা না চললেও ব্যাংকের কোনো গ্রাহক যদি পয়সাটা চান, ব্যাংক তাঁকে তা দিতে বাধ্য। কয়েনেজ অ্যাক্টের সংশোধন ছাড়া পয়সাকে অচল ঘোষণার সুযোগ নেই বলেও জানান তিনি।