পর্যটনকে আমলামুক্ত করতে হবে

সৈয়দ রাশিদুল হাসান
সৈয়দ রাশিদুল হাসান

নানা প্রতিকূলতা সামনে ঠেলে এগোচ্ছে দেশের পর্যটন খাত।  মানুষের আর্থিক সামর্থ্য বাড়ায় গত কয়েক বছরে দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটন খাত অনেকটাই সম্প্রসারিত হয়েছে। তবে একই সময়ে বিদেশ থেকে দেশে আসা পর্যটকের সংখ্যা কমে গেছে। আবার বাংলাদেশ থেকে বিদেশে ঘুরতে যাওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে। পর্যটন খাতের বিভিন্ন সমস্যা–সম্ভাবনা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ রাশিদুল হাসান ও বেঙ্গল ট্যুরস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশরাফুল ইসলাম

প্রথম আলো: বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প এখন সার্বিকভাবে কোন অবস্থানে আছে?

সৈয়দ রাশিদুল হাসান: পর্যটনের দুটি দিক আছে। একটি হলো অভ্যন্তরীণ পর্যটন, অন্যটি হলো বিদেশ থেকে যাঁরা এ দেশে ঘুরতে আসেন। সব দেশেই অভ্যন্তরীণ পর্যটন আগে গড়ে ওঠে, বাংলাদেশেও তাই হয়েছে। দেশের ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় লোক গেলে সেগুলো পরিচিত হয়ে উঠবে, দেশের বাইরে থেকে মানুষ সেখানে আসবে। অভ্যন্তরীণ পর্যটন বাংলাদেশে সাংঘাতিকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। বছরে অন্ততপক্ষে এখন ৫০ থেকে ৬০ লাখ লোক দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। শুধু কক্সবাজারেই যায় ১৫ থেকে ২০ লাখ লোক। কিন্তু আমাদের ব্যর্থতার জায়গাটা হচ্ছে বিদেশি পর্যটক সে হারে বাড়ছে না।

প্রথম আলো: বিদেশি পর্যটকেরা কেন এ দেশে আসছেন না?

সৈয়দ রাশিদুল হাসান: পর্যটনে বড় সমস্যা হলো এ-সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্তের প্রচণ্ড অভাব। তথ্য-উপাত্ত না থাকলে গবেষণা ও সঠিক পরিকল্পনা করা সম্ভব নয়। উপাত্তের জন্য ইউএনডব্লিউটিওর তথ্যের ওপর তাই আমাদের অনেকটা নির্ভর করতে হয়। এতে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটক আসার তথ্য রয়েছে। ২০১০ সালে বাংলাদেশে ৩ লাখ বিদেশি পর্যটক এলেও ২০১৪ সালে তা কমে ১ লাখ ২৫ হাজার হয়েছে। পর্যটক কেন কমছে, এ কারণগুলো দেখার জন্য গবেষণা করতে হবে। পাশের দেশ ভারতে শুধু বাংলাদেশি পর্যটকের সংখ্যা বাড়াতে করণীয় নিয়ে গবেষণা চলছে। বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো গবেষণা নেই, এমনকি এ নিয়ে চিন্তাভাবনা, উদ্যোগও নেই।

প্রথম আলো: বিদেশি পর্যটক আসা বাড়াতে কী করা যেতে পারে?

সৈয়দ রাশিদুল হাসান: ভারতে বিদেশি পর্যটক বাড়ানো নিয়ে এক গবেষণায় দেখা যায়, উন্নতি করতে হলে আমলাতন্ত্রের হাত থেকে এ খাতকে বের করে আনতে হবে। কারণ, পর্যটন নিয়ে আলাদা আগ্রহ ও জানাশোনা থাকতে হয়, এটা প্রথাগত আমলাদের দিয়ে চালানো সম্ভব নয়। ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয় এখন মূলত চলছে গবেষক এবং এ খাতের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে। বাংলাদেশেও এখন সেটা করতে হবে। পর্যটন মন্ত্রণালয়, পর্যটন করপোরেশন, বোর্ড—সব প্রতিষ্ঠান চলছে আমলাদের দিয়ে। এখানে পর্যটন খাতের বিশেষজ্ঞদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই।

প্রথম আলো: বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে ঘুরতে যাওয়ার প্রবণতা কেন বাড়ছে?

সৈয়দ রাশিদুল হাসান: ২০১৬ সালে বাংলাদেশ থেকে ১৫-১৬ লাখ লোক দেশের বাইরে গেছেন। এর বিপরীতে দেশে আসছেন ১ থেকে ২ লাখ লোক। বাইরে যাওয়া বাংলাদেশিরা বিদেশে গিয়ে কমপক্ষে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা খরচ করে আসছেন। এর বিপরীতে বাংলাদেশে আসছে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ে পর্যটন খাতের অবদান মাত্র দশমিক ৪৭ শতাংশ। সরকার যদি এই লাভ-ক্ষতির হিসাব বিবেচনায় না নেয়, তাহলে পর্যটনে প্রকৃত উন্নতি কখনোই হবে না। মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের বিশেষ আগ্রহে চিকিৎসাবিষয়ক পর্যটন উন্নতি করেছে। একইভাবে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভারতও এ খাতে এগিয়ে গেছে। একবার এসব খাতে উন্নতি করতে পারলে তা দীর্ঘ মেয়াদে সবার জন্য লাভজনক হবে।

প্রথম আলো: এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?

সৈয়দ রাশিদুল হাসান: পর্যটন খাতের উন্নতি বলতে বাংলাদেশে এখনো পাঁচ তারকা হোটেল, রাস্তাঘাট বা অবকাঠামো সুবিধার উন্নয়নকে বোঝায়। কিন্তু আমাদের প্রতিবেশী সব দেশ আগামী ৫০ বছরে পর্যটনের বাজার কী হবে, সে চিন্তা করছে। এখন পৃথিবীতে ৭২৫ কোটি জনসংখ্যার বিপরীতে পর্যটকের সংখ্যা ১০০ কোটি ছাড়িয়েছে। ২০৫০ সালে এই পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে ৪৫০ কোটিতে দাঁড়াবে। এখন ১০০ কোটি পর্যটকের ৫০ শতাংশ যাচ্ছে ইউরোপে, আর ২০ শতাংশ আসছে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশে। ২০৫০ সালে ৪৫০ কোটি পর্যটকের অর্ধেকই আসবে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। এই বাজার ধরতে ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ পরিকল্পনা শুরু করে দিয়েছে, বাংলাদেশ কিছুই করছে না। এসব বিষয় নিয়ে এখনই চিন্তাভাবনা শুরু করতে হবে। পর্যটনের উন্নতির জন্য গবেষণার সুযোগ তৈরি করতে হবে। পদ্মা সেতুর মতো বড় যেসব প্রকল্প এখন চলছে, সেগুলোকে ঘিরে পর্যটনকেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে।

প্রথম আলো: পর্যটনে এখন স্থানীয় লোকজনের অংশগ্রহণে জোর দেওয়া হচ্ছে। এটা কেন করা হচ্ছে?

সৈয়দ রাশিদুল হাসান: পর্যটনে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি দর্শনীয় স্থানকে কীভাবে টিকিয়ে রাখা যায়। আজকে সুন্দরবন যেমন আছে, আজ থেকে ১০০ বছর পরে পরবর্তী বংশধরেরা যাতে তেমনটি দেখতে পায়, সে অবস্থা তৈরি করা আমাদেরই দায়িত্ব। এটা টেকসইভাবে করতে হলে স্থানীয় লোকজনকে এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে, যেটাকে বলা হচ্ছে সিবিটি (কমিউনিটি বেসড ট্যুরিজম)। যেমন পাহাড়পুরে যেসব পর্যটক এখন বেড়াতে যায় সেখানে থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। সিবিটির মাধ্যমে স্থানীয় লোকজনকে দিয়ে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা সেখানে করা যেতে পারে।