নির্বাচনী বছরে ঋণে লাগাম নয়

বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণের লাগাম টানার উদ্যোগে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংগঠনটি এমন পরিকল্পনা থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে সরে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেছে, নির্বাচনী বছরে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তাতে সুদহার ও মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। এমনকি নতুন ঋণসীমা নির্ধারণ করা হলে তা সমন্বয় করতে বাড়তি ২০-২৫ হাজার কোটি টাকা নতুন আমানত প্রয়োজন হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে এমন মতামত তুলে ধরেছে এবিবি। সংগঠনটির পক্ষে ভাইস চেয়ারম্যান ও সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হুসেইন ১৫ জানুয়ারি এ চিঠি দিয়েছেন।

চিঠিতে এবিবি বলেছে, ঋণের হার কমানো হলে চলতি মূলধন, সাধারণ ঋণ বিতরণ, আমদানি বিল ও বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়ন অব্যাহত রাখা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের পাশাপাশি করপোরেট উদ্যোক্তারা তহবিল সংকটে পড়বে। তাই নির্বাচনী বছরে এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করা ব্যাংকগুলোর জন্য কঠিন হবে বলে মনে করছে এবিবি।

৩ জানুয়ারি সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সর্বশেষ মুদ্রানীতিতে ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ। মুদ্রানীতিতে লক্ষ্য ছিল এ খাতে ঋণপ্রবাহ ১৬ দশমিক ২ শতাংশে সীমাবদ্ধ থাকবে, নভেম্বরেই তা ১৯ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ হয়ে গেছে। তাই ঋণের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে ঋণ আমানত অনুপাত (অ্যাডভান্স ডিপোজিট রেশিও বা এডিআর) কমিয়ে আনা হবে বলে ওই সভায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়। তবে উন্নয়ন ব্যাহত হবে, এমন যুক্তি তুলে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা এখন এ সিদ্ধান্ত না নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বর্তমানে প্রচলিত ব্যাংকগুলোর জন্য ঋণ আমানত অনুপাত ৮৫ শতাংশ ও ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর জন্য ৯০ শতাংশ।

জানতে চাইলে এবিবির ভাইস চেয়ারম্যান ও যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা নির্বাচনী বছর, তাই উন্নয়নকাজ বেশি হবে। ঠিকাদারসহ অনেকের ঋণের চাহিদাও বাড়বে। আর উন্নয়ন না হলে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিও বাধাগ্রস্ত হবে। এ কারণে হঠাৎ করে ঋণ আমানত অনুপাত কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত আসবে না বলে আমরা মনে করি।’

গভর্নরের কাছে পাঠানো চিঠিতে এবিবি বলেছে, ‘আমরা উদ্বিগ্ন যে নিকট ভবিষ্যতে ঋণ আমানত অনুপাত কমিয়ে ৮০ দশমিক ৫ শতাংশ বা এর আশপাশে নামিয়ে আনা হবে। এমনটা হলে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার আমানতের প্রয়োজন হবে। আমরা আরও উদ্বিগ্ন যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের হার বাড়বে। কারণ, বাড়তি আমানত সংগ্রহের জন্য ব্যাংকগুলোকে আমানতের সুদ বাড়িয়ে দিতে হবে। তাতে শুধু এক ব্যাংকের আমানত আরেক ব্যাংকে চলে যাবে, নতুন আমানত আসবে না। কারণ, যে ব্যাংক আমানতের সুদ বাড়াবে, বিদ্যমান আমানতকারীরা অন্য ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে সেই ব্যাংকে খাটাবে। আবার আমানতের সুদ বাড়লে ব্যাংকগুলো ঋণের সুদও বাড়িয়ে দেবে, যা মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে চাপ সৃষ্টি করবে।’

এ অবস্থায় নতুন ঋণসীমা নীতিমালা করা হলে তা বাস্তবায়নে এক বছর সময় চেয়েছে এবিবি। সংগঠনটি বলেছে, যাদের ঋণসীমা বেশি, তাদের ক্যামেলস রেটিং নেতিবাচক করা যেতে পারে। এ ছাড়া ব্যাংকের মূলধনের ভিত্তি বাড়াতে টায়ার-২-এর আওতায় সাব-অর্ডিনেটেড বন্ডের যে তহবিল রয়েছে, সেটা ঋণসীমা হার হিসেবে গণ্য করার দাবি জানিয়েছে এবিবি। একই সঙ্গে অব ব্যালেন্সশিট আইটেমের বিপরীতে ব্যাংকের যে ১ শতাংশ সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়, তাতেও ছাড় চেয়েছে এবিবি।

৩ জানুয়ারি ব্যাংকার্স সভা শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী বলেছিলেন, ‘ঋণ বিতরণ প্রবৃদ্ধি ১৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এতে তারল্য সংকট হতে পারে। এ জন্য ঋণসীমা কমানো হতে পারে। নতুন মুদ্রানীতিতে এ বিষয়ে নির্দেশনা থাকবে।’

সূত্র জানায়, ঋণসীমা কমানো হবে, এমন পরিকল্পনা নিয়ে মুদ্রানীতি প্রণয়নের কাজ চলছে। তবে শেষ পর্যায়ে সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।