পোশাকশ্রমিকের মজুরি বাংলাদেশে সবচেয়ে কম

বিশ্বের তৈরি পোশাকশিল্পের বড় কারখানার পাঁচ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) চার দিনে যে আয় করেন, তা বাংলাদেশের একজন নারী পোশাকশ্রমিকের সারা জীবনের আয়ের সমান।

আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা অক্সফাম তাদের এক প্রতিবেদনে বৈষম্যের এই চিত্র তুলে ধরেছে। সংস্থাটি বলেছে, বিশ্বের সাত প্রধান তৈরি পোশাক উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশের শ্রমিকদের মজুরি সবচেয়ে কম। শোভন জীবনযাপনের জন্য যে অর্থ দরকার, তার চেয়ে অনেক কম অর্থ পান বাংলাদেশের শ্রমিকেরা।

‘রিওয়ার্ড ওয়ার্ক, নট ওয়েলথ’ নামের এ প্রতিবেদন গতকাল রোববার রাতে প্রকাশিত হয়। এ প্রতিবেদনে বিপুল সম্পদ সৃষ্টি এবং এসব সম্পদ যেসব মানুষের শ্রমে-ঘামে অর্জিত হয়, তাঁদের দারিদ্র্যের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। অক্সফাম এ প্রতিবেদন তৈরি করতে বিশ্বের ১০টি দেশের ১ লাখ ২৩০ হাজার মানুষের ওপর জরিপ করেছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ অংশে দেশের পোশাক কারখানার শ্রমিকদের জীবনমানের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে।

প্রতিবেদনে বিশ্বের সাতটি প্রধান পোশাক তৈরিকারক দেশের ন্যূনতম ও বসবাসের জন্য শোভন মজুরির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও আছে ভারত, চীন, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের শ্রমিকেরা সবচেয়ে কম মজুরি পান। বাংলাদেশে বসবাসের জন্য শোভন মজুরি প্রয়োজন ২৫২ মার্কিন ডলারের সমান অর্থ। এর বিপরীতে বাংলাদেশের একজন শ্রমিক পান ৫০ ডলার। ভারত ও শ্রীলঙ্কার শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৫০ ডলার। তবে ভারতে শোভন জীবনযাপনের জন্য ২০০ ডলার এবং শ্রীলঙ্কায় ২৫০ ডলারের বেশি অর্থ দরকার হয়।

প্রতিবেদনে নারী শ্রমিকদের দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। কাজের চাপে শৌচাগারে যেতে না পারায় অনেক অল্পবয়সী নারী শ্রমিক মূত্রনালির সংক্রমণে ভোগেন।

অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শুধু পোশাকশিল্প নয়, বাংলাদেশে সব ক্ষেত্রে আয়বৈষম্য বাড়ছে। এটা উদ্বেগের বিষয়। বেসরকারি সংগঠন পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর বলেন, বাংলাদেশে পোশাকশিল্পের প্রসারে ‘সস্তা শ্রমিক’ ধারণাটা বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের অগ্রগতির মূলে থাকবে দক্ষ শ্রমিকের বিষয়টি। সেখানে মজুরি বাড়ানোর ও বৈষম্য কমানোর বিষয়টি জরুরি।

তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান অক্সফামের এই প্রতিবেদনের তথ্য প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, অন্য পোশাক উৎপাদনকারী দেশের চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থা অনেক ভালো। অক্সফাম তাঁদের সঙ্গে কোনো কথা বলেনি বলে অভিযোগ করেন তিনি।

বিজিএমইএ সভাপতির বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে অক্সফাম বাংলাদেশের কর্মসূচি পরিচালক এম বি আখতার বলেন, গবেষণার জন্য মালিক, শ্রমিক সংগঠন ও সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। তাঁদের কথা শোনা হয়েছে।

অক্সফামের প্রতিবেদনে শ্রমিকদের আয়বৈষম্যের চিত্রকে যথার্থ বলে মনে করেন বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখ্তার। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, বেঁচে থাকার জন্য নারী শ্রমিক ওভারটাইম করতে বাধ্য হন। কিন্তু ওভারটাইম করেও ভালোভাবে বেঁচে থাকার মতো অর্থ তাঁরা এখনো পান না।

কোটিপতি আরও বেড়েছে

প্রতিবেদনে অক্সফাম বিশ্বজুড়ে আয়বৈষম্যের চিত্রও তুলে ধরেছে। যেমন গত বছর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি কোটিপতি বেড়েছে। বিশ্বে প্রতি দুই দিনে একজন করে মানুষ কোটিপতি হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রতি ১০ জনের ৯ জনই পুরুষ। যারা কোটিপতি আছেন, তাঁদেরও সম্পদ বেড়েছে ব্যাপক হারে। গত বছর বিশ্বে যে পরিমাণ সম্পদ উৎপাদিত হয়েছে, তার মালিক বিশ্বের মাত্র ১ শতাংশ ধনী মানুষ। দরিদ্র ৫০ শতাংশ মানুষ এ সম্পদের কোনো কিছুই পায়নি।

অক্সফাম বলেছে, বিশ্বের ১০০টির বেশি দেশে নাগরিক অধিকার ব্যাপকভাবে হুমকির মুখে পড়েছে। এসব দেশে দিন দিন মানুষের কথা বলার অধিকার কমে যাচ্ছে।

এই বিপুল বৈষম্য রোধে একগুচ্ছ পরামর্শ দিয়েছে অক্সফাম। তারা সুনির্দিষ্ট ও সময় নির্ধারণ করে কর্মসূচি তৈরির জন্য বিভিন্ন দেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সরকারগুলো যেন শ্রমিকদের জীবনমানের উপযোগী মজুরি নিশ্চিত করে। তারা মজুরির ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য দূর করাসহ ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ওপর করারোপের পরামর্শ দিয়েছে অক্সফাম। আয়বৈষম্য দূর করতে দরিদ্র শ্রমিকদের মুনাফার ভাগ দেওয়ার পরামর্শ তাদের।