ঋণ-সংকট যেন তৈরি না হয়

চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য আগামী সোমবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে কী ধরনের মুদ্রানীতি প্রত্যাশা করা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আবুল কাসেম খান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাজীব আহমেদ

প্রথম আলো: আপনারা কী ধরনের মুদ্রানীতি প্রত্যাশা করছেন?

আবুল কাসেম খান: আমরা সব সময়ই বলি, মুদ্রানীতিতে বাণিজ্যের বদলে উৎপাদনশীল খাতে অর্থের সরবরাহে বেশি জোর দেওয়া উচিত। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণ বাড়াতে হবে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বেকারের হার আগামী বছর একই থাকবে। আমাদের উদ্দেশ্য কর্মসংস্থান তৈরি করে দারিদ্র্যের হার কমানো। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে কর্মসংস্থান বেশি হয়।

প্রথম আলো: ব্যাংক ঋণের সুদের হার ও ঋণের জোগান ইত্যাদি ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রবণতা কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?

আবুল কাসেম খান: এখন দেখা যাচ্ছে ব্যাংকগুলোতে তারল্যের জোগানে চাপ তৈরি হচ্ছে। তারা ঋণের সুদের হার বাড়াচ্ছে। আবার এ বছর নির্বাচন হবে। নির্বাচনের বছরে সরকারের ব্যয় বাড়বে। যেকোনো রাজনৈতিক সরকার এটা করে থাকে। সব মিলিয়ে আমাদের আশঙ্কা বেসরকারি খাতে একটি ক্রেডিট ক্রাঞ্চ (ঋণ সংকটকাল) আসছে। তবে আমরা চাইব এটা যাতে না হয়। বেসরকারি খাতে ঋণ সরবরাহ বৃদ্ধির ব্যবস্থা রাখা হয়। রাজনৈতিক কারণে অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলে, এমন নীতি নেওয়া উচিত হবে না। আরেকটা জিনিস আমরা বারবার বলি, মানসম্পন্ন ঋণ নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংকের লক্ষ্য পূরণের জন্য ঋণ বিতরণ মনে হয় ভুল হবে।

প্রথম আলো: মানসম্পন্ন ঋণ বলতে আপনি কী বোঝাচ্ছেন?

আবুল কাসেম খান: এর মানে হিসেবে আমি বলছি, ঋণ বিতরণে আরেকটু সতর্ক হওয়া। ব্যাংক ঋণ দেওয়ার আগে যাতে বেশি যাচাইবাছাই করা হয়। এখন কিন্তু খেলাপি ঋণের হার বেড়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ এটা মোট ঋণের ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

প্রথম আলো: তাহলে আপনি বলছে, মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহে যাতে কোনো রাশ টানা না হয়, সেটাই আপনারা চান?

আবুল কাসেম খান: আপনি ঠিকই বলছেন। যেহেতু একটা ধারণা থাকে, নির্বাচনের বছর ঋণ সরকারি খাতেই বেশি দেওয়া হয়। বেসরকারি খাতেও যাতে সেটা ঠিক থাকে, আমরা সেটাই চাইব।

প্রথম আলো: আপনি যে প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, সেই এ কে খান গ্রুপের কথা যদি বলি, সেখানে কত শতাংশ সুদে আপনারা ঋণ পাচ্ছেন?

আবুল কাসেম খান: আমাদের ঋণের সুদ হার দুই অঙ্কে চলে গেছে। এখন আমরা ১০ থেকে ১২ শতাংশ সুদে ঋণ পাচ্ছি।

প্রথম আলো: এ হার কি কয়েক মাস আগে আরও কম ছিল?

আবুল কাসেম খান: অবশ্যই কম ছিল। এখন আগের চেয়ে ২ থেকে ৩ শতাংশ বাড়তি সুদে ঋণ নিতে হচ্ছে। আগে আমানতের সুদের হার ৬ শতাংশের কম ছিল। ব্যাংকগুলো আমাদের কোম্পানির মতো প্রতিষ্ঠানকে ৮ থেকে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ প্রস্তাব দিত।

প্রথম আলো: আপনারা কী ব্যাংকগুলোতে ঋণ ও আমানতের সুদের হারের পার্থক্য কমিয়ে আনা, দক্ষতা বৃদ্ধি, খেলাপি ঋণ কমানো ইত্যাদির মাধ্যমে সুদের হার কমানোর চেষ্টা দেখেন?

আবুল কাসেম খান: আমরা সেটা দেখতে পাচ্ছি না। ব্যাংকগুলোকে তাদের সামগ্রিক ব্যয় কাঠামোতে আরও দক্ষ হতে হবে। খেলাপি ঋণের বিষয়টিও সেখানেই এসে যায়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক নজরদারি করছে। তবে সেটা বাড়াতে হবে। প্রথম আলো: বাণিজ্যিক ব্যাংক সাধারণত ৭-৮ বছরের জন্য প্রকল্প ঋণ দেয়। এ ছাড়া শেয়ার ছেড়ে পুঁজিবাজার থেকেও অর্থের জোগান আসতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদে কম সুদের ঋণ নেওয়ার জন্য আর কোনো বিকল্পের কথা আপনারা বলছেন না কেন? বিকল্প কি আছে?

আবুল কাসেম খান: এ প্রশ্নটির জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি আসল জায়গা নিয়ে কথা বলেছেন। বাণিজ্যিক ব্যাংক দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ দেয় না। নানা কারণে পুঁজিবাজারেও আমরা যাচ্ছি না। আমরা সরকারকে বলছি, বন্ড বাজার চালু হোক। এটিকে একটি নীতিমালার মধ্যে আনতে হবে। বন্ড বাজার থেকে অবকাঠামো ও বেসরকারি খাতে অর্থের জোগান আসতে পারে। ধরেন আমরা এ কে খান ইকোনমিক জোনের বন্ড ছাড়লাম। নিয়মিত মুনাফা পেলে বিনিয়োগকারীরা এসব বন্ড কিনবে। সব মিলিয়ে অর্থায়নের বিভিন্ন উৎস থাকতে হবে। নইলে বড় প্রকল্পের অর্থায়ন নিশ্চিত করা যাবে না।

প্রথম আলো: বিষয়টা হলো, এখন বেসরকারি খাতে অনেক বড় বড় বিনিয়োগ হচ্ছে। ব্যাংকগুলো জোটবদ্ধ হয়ে ৩০০-৪০০ কোটি টাকার ঋণ দিচ্ছে। কিন্তু অনেক সময় দেখা যাচ্ছে পরিমাণ আরও বেশি দরকার। বর্তমান ব্যাংক খাত কি সেই চাহিদা পূরণ করতে পারছে?

কাসেম খান: না, তা পারছে না। এখন সময় এসেছে এ বিষয়ে চিন্তা করার। বিনিয়োগ কিন্তু এখন সেবা খাত ও অবকাঠামোতে বেশি হচ্ছে। সেখানে বাড়তি ঋণ ও দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ দরকার।

প্রথম আলো: দেশে ব্যাংকের সংখ্যা এখন ৫৭টি। সংখ্যা বেশি হওয়ায় প্রতিযোগিতার কারণে কি সুদের হার কমছে? আদৌ কোনো প্রতিযোগিতা কি আপনি দেখতে পাচ্ছেন? পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর ঋণ পণ্যের ক্ষেত্রে কি কোনো বৈচিত্র্য আছে?

কাসেম খান: আমি সব ব্যাংকে একই ধরনের ঋণ পণ্য দেখছি। ঋণের সুদের হার কারও একটু কম, কারও একটু বেশি। কেউ একটু দ্রুত সেবা দেয়, কেউ একটু ধীর। এর বাইরে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই।