১০৩ ঘণ্টার অপেক্ষা

>
  • চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাসে সবচেয়ে বেশি সময় লাগছে।
  • নতুন বছরের শুরুতেও অপেক্ষার সময় কমেনি।
  • ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কনটেইনারে আমদানি করা পণ্য হাতে পেতে গত দুই দশকের মধ্যে এখন সবচেয়ে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর গড়ে প্রতিটি কনটেইনারের পণ্য হাতে পেতে চার দিনের বেশি বা ১০৩ ঘণ্টা সময় লেগেছে। নতুন বছরের শুরুতেও এ অপেক্ষার সময় কমেনি।

পণ্য বুঝে পেতে সময় বেশি লাগায় ব্যবসায়ীরা দুইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। প্রথমত, আমদানিকারকেরা দেরিতে কাঁচামাল হাতে পাওয়ায় কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আবার যথাসময়ে পণ্য না পাওয়ায় বাজারজাতও সময়মতো করা যাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘ অপেক্ষার কারণে খরচ বেড়ে যাওয়ায় জাহাজ কোম্পানিগুলো ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে। আমদানিকারকদের এ বাড়তি ভাড়া পরিশোধ করতে হয়, শেষ পর্যন্ত যা ভোক্তার কাছ থেকে আদায় করেন ব্যবসায়ীরা। অর্থাৎ বন্দর সুবিধার অভাবের বাড়তি খরচের দায় মেটাতে হচ্ছে শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদেরই। 

বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, বন্দরে কনটেইনারে পণ্য পরিবহন বাড়লেও গত ১০ বছরে অবকাঠামো সুবিধা তেমন বাড়েনি। তৈরি হয়নি নতুন কোনো জেটি। তাতেই বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সীমিত অবকাঠামো ব্যবহার করে সেবা বাড়াতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। পণ্য খালাসে গতি আনতে নতুন যেসব জেটি নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, সেগুলো সময়মতো শেষ হচ্ছে না।

 গত বছর বেশি সময় সাগরে অলস ভেসে থাকায় চট্টগ্রাম বন্দর রুটে ফিডার জাহাজ পরিচালনাকারীদের খরচ বেড়ে গেছে। বন্দরের তথ্যের ভিত্তিতে হিসাব করে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে ফিডার জাহাজ পরিচালনাকারীদের বাড়তি খরচ হয়েছে ৫৩৩ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে তা ছিল ৩২১ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে ছিল ৯৩ কোটি টাকা। এই খরচ কনটেইনার পরিবহনের ভাড়া বাড়িয়ে তুলে নেওয়া হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কনটেইনারে পণ্য আমদানিতে একক খাত হিসেবে শীর্ষে পোশাকশিল্প। এই খাতের ব্যবসায়ীরা মূলত কাপড়, সুতা ও সরঞ্জাম আমদানি করেন কনটেইনারে। এই কাঁচামাল দিয়ে পণ্য উৎপাদন করে আবার কনটেইনারে করে তা রপ্তানি করা হয়। পোশাকের পরই অবস্থান বিভিন্ন শিল্প-কারখানা ও বাণিজ্যিক আমদানিকারকদের।

পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর বন্দর ও জাহাজীকরণ-বিষয়ক স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন চৌধুরী গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পণ্য হাতে পেতে দেরি হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে আছেন পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা। বন্দর সুবিধার অভাবে পোশাকের বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা যেমন কমছে, তেমনি প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় সক্ষমতাও হারাচ্ছি আমরা।’ পোশাক খাতের এই ব্যবসায়ী জানান, তাঁর প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা কাঁচামালের একটি কনটেইনার ১০ দিন পর হাতে পেয়েছেন তিনি। এ জন্য কারখানার উৎপাদন দুই দিন বন্ধ রাখতে হয়েছে।

 বিদেশ থেকে যত কনটেইনার পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়, তার ৯৮ শতাংশ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আনা-নেওয়া হয়। বাকি ২ শতাংশ আনা-নেওয়া হয় মোংলা বন্দর দিয়ে। তাই চট্টগ্রাম বন্দরের সেবার মান কমলে সারা দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

বন্দরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৭ সালে প্রতিটি কনটেইনারবাহী জাহাজ বন্দর জলসীমায় আসার পর জেটিতে ভেড়ানোর সুযোগ পেয়েছে গড়ে ১০৩ ঘণ্টা পর। ১৯৯৮ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত ২০ বছরে এটি ছিল সর্বোচ্চ সময়। বন্দর দিয়ে কনটেইনার পরিবহনের ৪০ বছরের ইতিহাসে ২০ বছরের প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে এ চিত্র পাওয়া গেছে।

বন্দর সূত্রে জানা গেছে, ২০০৬ সালে বন্দরে জাহাজ ভেড়ার পর আমদানি পণ্য হাতে পেতে ব্যবসায়ীদের গড়ে ৭৮ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিল। সেটি ছিল পণ্য পেতে বন্দরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অপেক্ষা। ২০০৬ সালে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ উত্তাল ছিল। এ কারণে পণ্য খালাসে বেশি সময় লেগেছিল। এরপর ২০১৬ সালে পণ্য হাতে পেতে গড় অপেক্ষার সময় ছিল ৭৫ ঘণ্টা। ২০১৫ সালে এ অপেক্ষার গড় সময় ছিল প্রায় ৩১ ঘণ্টা।

 বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকের মধ্যে পণ্য পেতে সবচেয়ে কম সময় লেগেছে ২০০৮ ও ২০০৯ সালে। এ সময় পণ্য হাতে পেতে গড়ে ১১ ঘণ্টা সময় লাগত। সাগরের জোয়ার ছাড়া বন্দর জেটিতে জাহাজ ভেড়ানো যায় না। তাই জাহাজ থেকে খালাসের পর পণ্য বুঝে পেতে ১১ ঘণ্টা অপেক্ষাকে স্বাভাবিক বলে ধরা হতো। ২০০৮ ও ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার।  ওই সময় বন্দরের সেবার মান উন্নয়নে ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়।

 ফিডার জাহাজ ও কনটেইনার পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ কনটেইনার শিপিং অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ক্যাপ্টেন আহমেদ সাহেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সাময়িক খরচ বাড়লে সাধারণত ফিডার জাহাজ পরিচালনাকারীরা ভাড়া বাড়ায় না। তবে এবার টানা অপেক্ষার কারণে ফিডার জাহাজে কনটেইনার পরিবহনের ভাড়া গড়ে কমবেশি ১৫ শতাংশ বাড়িয়েছে কোম্পানিগুলো। বন্দর সুবিধা যত বাড়বে ভাড়াও তত কমে যাবে।

 এদিকে বন্দর সুবিধা বাড়াতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েও সামাল দিতে পারছে না বন্দর কর্তৃপক্ষ। জানতে চাইলে বন্দর সচিব ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, দুই বছরের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে পতেঙ্গা টার্মিনালের কাজ শুরু হচ্ছে। লালদিয়া ও বে টার্মিনাল নির্মাণের প্রক্রিয়াও চলছে। আবার এ বছরেই জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর মূল যন্ত্র ছয়টি গ্যান্ট্রি ক্রেন, কনটেইনার রাখার জন্য নতুন চত্বর যোগ হবে এ বছর। নতুন জেটি না আসা পর্যন্ত সেবার মান বাড়াতে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। 

তবে বন্দরের পর্ষদ সদস্য হাদী হোসাইন বলেন, সংস্কার করে কনটেইনারে পণ্য পরিবহন ক্ষমতা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বাড়ানো যাবে।