উপকার পাবে দেশের মানুষ

সাংবাদিকদের মুখোমুখি নভো নরডিস্কের দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার করপোরেট ভাইস প্রেসিডেন্ট শবনম আভসার টুনা (বাঁয়ে) ও এসকেএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিমিন হোসেন। গত বুধবার ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলে। ছবি: প্রথম আলো
সাংবাদিকদের মুখোমুখি নভো নরডিস্কের দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার করপোরেট ভাইস প্রেসিডেন্ট শবনম আভসার টুনা (বাঁয়ে) ও এসকেএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিমিন হোসেন। গত বুধবার ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলে। ছবি: প্রথম আলো
ডেনমার্কের বিশ্বখ্যাত ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান নভো নরডিস্কের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশে ডায়াবেটিসের পেনফিল পদ্ধতির ইনসুলিন উৎপাদন করবে ট্রান্সকম গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস। এ জন্য গত বুধবার রাজধানীতে উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের পর এক মঞ্চে বসে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন নভো নরডিস্কের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার করপোরেট ভাইস প্রেসিডেন্ট শবনম আভসার টুনা ও এসকেএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সিমিন হোসেন। সেখানে তাঁরা পেনফিল ইনসুলিন তৈরির প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং বাংলাদেশের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীরা তাতে কীভাবে উপকৃত হবে, দুই প্রতিষ্ঠানের একসঙ্গে পথচলার ইতিহাস, সুফল ইত্যাদি নানা বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন আয়েশা কবিরজাহাঙ্গীর শাহ


প্রথম আলো:
মডার্ন ইনসুলিন উৎপাদনে বাংলাদেশকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি স্থানান্তর করছে ডেনমার্ক, যা একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এটি কীভাবে এ দেশের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাহায্য করবে?

শবনম আভসার টুনা: আমি যত দূর জানি, বাংলাদেশে ৭০ লাখের মতো ডায়াবেটিস রোগী আছে। বাংলাদেশে এমন অনেক লোক আছেন, যাঁরা জানেন না তাঁরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আবার অনেকেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলেও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণের সামর্থ্য তাঁদের নেই। যখন কারও ডায়াবেটিস চিহ্নিত হবে, তখন তাঁকে চিকিৎসার ব্যবস্থা হিসেবে ইনসুলিন নিতেই হবে। ইনসুলিন ছাড়া একজন ডায়াবেটিস রোগী নির্দিষ্ট বয়সের পরে আর বাঁচতে পারবেন না। তাই ইনসুলিন হলো একটি জীবন রক্ষাকারী পণ্য। নভো নরডিস্ক সারা বিশ্বের চাহিদার ৫০ শতাংশ ইনসুলিন উৎপাদন করে। বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীদেরও একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর ইনসুলিন প্রয়োজন। ইনসুলিন নিয়ে আমরা (নভো নরডিস্ক) ৬০ বছর ধরে বাংলাদেশে আছি। কয়েক বছর আগে সরকার এই দেশেই ইনসুলিন উৎপাদন করে সরবরাহের উদ্যোগ নেয়। এরপর এসকেএফের সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে এ দেশে ভায়েল ইনসুলিন উৎপাদন ও বাজারজাত করে আসছে নভো নরডিস্ক। এখন এসকেএফের সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে বাংলাদেশেই এই মডার্ন ইনসুলিন উৎপাদন করব।

প্রথম আলো: এসকেএফ হলো দেশের অন্যতম নেতৃত্বস্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানি। নভো নরডিস্কের সঙ্গে সম্পর্ককে আপনি কীভাবে দেখেন এবং প্রযুক্তি স্থানান্তরের ফলে বাংলাদেশ কীভাবে উপকৃত হবে?

সিমিন হোসেন: প্রথমেই বলতে চাই, ভায়েল ইনসুলিন উৎপাদন করার মাধ্যমে আমরা নভো নরডিস্কের সঙ্গে আট বছর ধরে সফলভাবে কাজ করছি। এই সময়ে আমরা নভো নরডিস্কের কাছ থেকে সব সময়ই প্রয়োজনীয় নানা সহায়তা পেয়েছি। পণ্যের গুণমান, ব্যবস্থাপনা, উৎপাদনসহ ব্যবসার প্রতিটি স্তরের বিভিন্ন বিষয়ে তাদের কাছ থেকে শিখেছি। শুধু এসকেএফ নয়, পুরো ওষুধশিল্পের জন্য যা অত্যন্ত শিক্ষণীয় বিষয়। পেনফিল পদ্ধতির ইনসুলিন উৎপাদনের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি স্থানান্তর সম্পর্কে আমি বলব, এটা উভয় প্রতিষ্ঠানের (এসকেএফ ও নভো নরডিস্ক) জন্য একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এত দিন আমরা ভায়েল ইনসুলিন উৎপাদন করেছি। এখন আমরা গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, এখানে আমরা নভো নরডিস্কের জন্য যে ইনসুলিন তৈরি করেছি, এর মান ডেনমার্কে উৎপাদিত ইনসুলিনের মানের সমান।

প্রথম আলো: নভো নরডিস্ক এ দেশে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। এই উদ্যোগগুলো ডায়াবেটিস রোগীদের কীভাবে উপকার করবে?

শবনম আভসার টুনা: অসংক্রামক ব্যাধিগুলোর মধ্যে ডায়াবেটিস হলো সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর। এটি শুধু ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যার দিক থেকে নয়, এটা অর্থনীতির জন্যও বড় বোঝা। নানা ধরনের জটিলতার মধ্য দিয়ে ডায়াবেটিস রোগীকে যেতে হয়। এটা যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা না যায়, তবে এটা আপনার চোখ, কিডনি, হার্টের ক্ষতি করতে থাকবে। তাই আমরা বলি, ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করা বেশি ব্যয়বহুল নয়, কিন্তু চিকিৎসা করা না হলেও যে ক্ষতি হবে, তা আরও বেশি ব্যয়বহুল।

নভো নরডিস্কের বৈশ্বিক উদ্যোগগুলোর কিছু এ দেশে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রথমটি হলো ডায়াবেটিস চিহ্নিত করতে রক্তের পরীক্ষা করা ও রোগী চিহ্নিত করা। দ্বিতীয়ত, এই খাতের পেশাজীবীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। কেননা তাঁরা সারা দেশে ডায়াবেটিসের রোগীদের চিকিৎসা করেন। 

প্রথম আলো: বাংলাদেশে ওষুধশিল্পের সম্প্রসারণ হচ্ছে। এই শিল্পের বিকাশে কী কী করছে এসকেএফ?

সিমিন হোসেন: এই শিল্পের বিকাশে মানবসম্পদ হলো অন্যতম উপাদান। আমি সত্যিই মনে করি, আমাদের দক্ষ ও পেশাদার লোক আছে। আমাদের লোকেরা পেশাজীবনে মেধার সর্বোচ্চটুকু কাজে লাগান। দক্ষ মানবসম্পদই হলো আমাদের বড় শক্তি। কারণ, পণ্যের উৎপাদন ও সংরক্ষণে সর্বোচ্চ মান বজায় রাখতে কাজ করে এই দক্ষ মানবসম্পদ।

পণ্যের উচ্চমান বজায় রাখতে এসকেএফ ব্যবসার প্রতিটি স্তরে অত্যন্ত নৈতিকতা বজায় রেখে কাজ করে থাকে। যার স্বীকৃতি আমরা এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কাছ থেকে পেয়েছি। এই সংস্থাগুলোর মধ্যে আছে ইউকেএমএইচআরএ, টিজিএ অস্ট্রেলিয়া, ইউনিসেফ। এ ধরনের স্বীকৃতিই প্রমাণ করে, আমরা যে পণ্য উৎপাদন করি, তা বিশ্বমানের।

উচ্চমান ও নৈতিকতাসম্পন্ন বৈশ্বিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এসকেএফের অংশীদারি আছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো নভো নরডিস্ক। এ ছাড়া নোভারটিস ও সার্ভিয়ারের মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও আমাদের অংশীদারত্ব আছে।

প্রথম আলো: এসকেএফের সঙ্গে নভো নরডিস্কের সফল অংশীদারত্বের পেছনে কী মূলমন্ত্র কাজ করেছে?

শবনম আভসার টুনা: আমি আবার বলব, এসকেএফের সঙ্গে অংশীদার হয়ে আমরা খুবই সন্তুষ্ট। ভায়েল ইনসুলিন উৎপাদনের মাধ্যমে ২০০৯ সালে আমরা এসকেএফের সঙ্গে প্রথমবারের মতো যুক্ত হই। বৈশ্বিক কোম্পানি হিসেবে আমাদের বিভিন্ন বিষয়ে মান বজায় রাখতে হয়। এসকেএফকেও সমমান বজায় রাখতে বলা হয়। এসকেএফ অত্যন্ত পেশাদারির সঙ্গে সেই মান বজায় রাখতে সব ধরনের চাহিদা পূরণ করেছে। উচ্চ মান ও বিশ্বস্ততার কারণে রোগীরা এখন এসকেএফের পণ্য ব্যবহার করেন। তাই নভো নরডিস্কের নতুন যে প্রযুক্তি স্থানান্তর করা হচ্ছে, তা নিয়েও আমরা বেশ আত্মবিশ্বাসী।

প্রথম আলো: বাংলাদেশে ওষুধশিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা আছে। আপনি এসকেএফের মতো বড় প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। একজন নারী ব্যবসায়ী নেতা হিসেবে এই শিল্পে আপনি কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছেন?

সিমিন হোসেন: আমি যখন এই শিল্পে আসি, তখন শীর্ষপর্যায়ে খুব বেশি নারী ব্যবসায়ী ছিল না। এখন অবশ্য অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। শুধু ওষুধশিল্পে নয়, বাংলাদেশের প্রায় সব ব্যবসা খাতেই নারী নেতৃত্ব আছে। একজন পেশাদার হিসেবে আমি কাজ করতে এসে কিংবা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো বাধা অনুভব করিনি। আমি মনে করি, নারী-পুরুষ কোনো বড় বিষয় নয়। ব্যবসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নেতৃত্বগুণ। নারী-পুরুষ যা-ই হোক না কেন, একজন নেতার যোগ্যতাই বড় বিষয়। ওষুধশিল্পের মতো বর্ধনশীল শিল্প কিংবা অন্য যেকোনো শিল্প টেকসই করতে ভূমিকা রাখবে নেতৃত্বের যোগ্যতা। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, কোনো ব্যক্তির লিঙ্গপরিচয় সাফল্য আনতে আলাদাভাবে কাজ করে না।