লোকসানে দায়ী তিন 'অ'

>
  • ঘুরে দাঁড়াতে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা চায় সংস্থাটি।
  • ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিজেএমসিকে দেওয়া হয়েছে ৬ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) একটি লোকসানি সংস্থা হওয়ার পেছনে দায়ী মূলত তিনটি ‘অ’। এগুলো হচ্ছে—অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম। ২৬টি প্রতিষ্ঠান নিয়ে সংস্থাটি লোকসানি হওয়ার জন্য আরও দায়ী করা হচ্ছে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাটকলগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন করতে না পারা।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা বিজেএমসি ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা চাওয়ার পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সংস্থাটিকে এভাবেই মূল্যায়ন করেছে। মূল্যায়নটি শিগগির সার-সংক্ষেপ আকারে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে উপস্থাপন করবে অর্থ বিভাগ।

অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় সম্প্রতি ঢাকার গুলশান এলাকার ১০ দশমিক ৩৩ বিঘা জমি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কাছে বিক্রি করেছে বিজেএমসি। জমির দাম ১ হাজার ৮০ কোটি টাকা।

তবে, এই সময়ে সরকারের কাছে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা চায় বিজেএমসি। বিজেএমসিকে এই পরিমাণ টাকা দিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় মনে করে, এই টাকা পেলেই বিজেএমসি একটি স্বাবলম্বী সংস্থা হিসেবে গড়ে উঠবে।

বিজেএমসির চাওয়ার মধ্যে ১ হাজার কোটি টাকা হচ্ছে আবর্তক তহবিল বাবদ। এই টাকা চায় তারা একবারে। আর ৮০০ কোটি টাকা চায় তারা শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের বকেয়া গ্র্যাচুইটি, মহার্ঘ্য-ভাতা ও ভবিষ্য তহবিলের (পিএফ) জন্য নগদ ঋণ হিসেবে।

আবর্তক তহবিলের জন্য ১ হাজার কোটি টাকা চাওয়ার যুক্তি হিসেবে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় বলেছে, নগদ টাকার অভাবে প্রতিবছর বাকিতে এবং বেশি দাম দিয়ে বিজেএমসিকে কাঁচা পাট কিনতে হয়। আর এ জন্য বছরে বেশি পরিশোধ করতে হয় গড়ে ৬৮ কোটি টাকা। ১ হাজার কোটি টাকার একটি আবর্তক তহবিল থাকলে প্রতিবছর নতুন বরাদ্দের আর দরকার পড়বে না। অর্থাৎ এই তহবিলের আয় দিয়েই কাঁচা পাট কেনা যাবে।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিজেএমসিকে টাকা দেওয়া বা না-দেওয়ার ব্যাপারে সরাসরি কিছু বলেননি। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে তিনি অর্থসচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরীর উদ্দেশে শুধু বলেছেন, ‘বিজেএমসিকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ার জন্য কী করা যায়, কত টাকা দেওয়া যায়, ভেবে বলুন।’

অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, অর্থমন্ত্রীর ওই মন্তব্য বিবেচনায় নিয়েই তাঁর কাছে বিষয়টি উপস্থাপনের জন্য একটি সার-সংক্ষেপ তৈরি করছেন অর্থসচিব। অর্থ বিভাগের মূল্যায়নে এসেছে যে ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত বিজেএমসিকে ৬ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে এবং বিজেএমসির শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বেসরকারি পাটকলগুলোর চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।

বিজেএমসিতে বর্তমানে কর্মকর্তা, শিক্ষক, শ্রমিক ও কর্মচারী মিলিয়ে স্থায়ী চাকরিজীবী ৩৩ হাজার ১৯১ জন এবং বদলি ও দৈনিকভিত্তিক শ্রমিক ৩০ হাজার ৯৫২ জন। সংস্থার অধীনে তিনটি নন জুট প্রতিষ্ঠানসহ ২৬টি কল রয়েছে।

ঢাকা অঞ্চলের অধীনে ৭টি, চট্টগ্রাম অঞ্চলের অধীনে ১০টি এবং খুলনা অঞ্চলের অধীনে ৯টি কল রয়েছে। এগুলো দেখাশোনা ও সমন্বয়ের জন্য বিজেএমসির আঞ্চলিক কার্যালয় রয়েছে দুটি। তবে একটি নন-জুট প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব কটিই লোকসানি।

এদিকে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিজেএমসির পাটকলগুলোকে ঘিরে ১ হাজার ১৫৮টি মামলা রয়েছে। বেশির ভাগ মামলাই জজকোর্ট এবং শ্রম আদালতের আওতায়।

২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ পাট খাতকে লাভজনক করার অঙ্গীকার করেছিল। প্রায় ১০ বছর হতে চললেও সংস্থাটি আগের মতোই আছে। পাটকল শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি ও ভাতা পরিশোধসহ পাট খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের জন্য ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি পরিকল্পনা তুলে ধরে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রী তখন বিজেএমসির অধীনে থাকা গুলশানের ১০ দশমিক ৩৩ বিঘা জমি বিক্রি করে তহবিল সংগ্রহের নির্দেশ দেন।

সেই জমিই কিনে নেয় যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ওই জমিতে রাজধানীর শিশু-কিশোরদের জন্য খেলার মাঠ তৈরি হবে।

জানতে চাইলে বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, টাকা পাওয়া গেছে ঋণ হিসেবে, যা এরই মধ্যে খরচও হয়ে গেছে। আবর্তক তহবিলটা পেলে কাঁচা পাট কেনার কাজটা সহজ হয়ে যাবে। বিজেএমসির পক্ষেও তখন ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে।

অদক্ষতা, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার জন্য বিজেএমসি একটি লোকসানি সংস্থা, এতে কোনো ভুল নেই বলে স্বীকার করেন মির্জা আজম। তিনি বলেন, ‘লোকসান কমছে। তবে বিজেএমসি সম্প্রতি গুলশানে জমি বিক্রি করে যেভাবে টাকা পেয়েছে, সেইভাবে যদি আদমজী পাটকলের জমি বিক্রির টাকা পেত, সংস্থাটিকে লোকসানি বলতে হতো না।’