ঋণ কিনে বিশেষ সুবিধা, অতঃপর খেলাপি

বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণ কিনে বিপদ ডেকে এনেছে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। জারা কম্পোজিট টেক্সটাইল নামের ওই প্রতিষ্ঠানের ঋণ কিনেই ক্ষান্ত হয়নি স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, নতুন করে আরও প্রায় ৫ গুণ বেশি টাকা দিয়েছে। ফলে সব মিলিয়ে অর্থায়ন দাঁড়িয়েছে ১৩৩ কোটি টাকা। এখন এ ঋণের পুরোটাই খেলাপি হয়ে গেছে। অথচ এ ঋণকে সুদমুক্তসহ সব ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়েছিল।

জানা গেছে, এ খেলাপি ঋণ আদায়ে এখন আইনি পথে হাঁটছে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এ ঋণে অনিয়মের জন্য ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নাজমুস সালেহীনকে দায়ী করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৩ সালের অক্টোবর থেকে ৩ বছর ব্যাংকটির দায়িত্বে ছিলেন তিনি। এরপর আবার তাঁকেই স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।

কাগজে-কলমে বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বদরুল আহসান। তবে ২০১৩ সালের আগে এর সিংহভাগ শেয়ারের মালিক ছিলেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু।

জানতে চাইলে নাজমুস সালেহীন গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব অভিযোগ তুলেছিল, তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। কোনো সুদ মওকুফও করা হয়নি। প্রকল্পটি ভালো দেখেই অর্থায়ন করা হয়েছিল, এখন খারাপ হয়ে পড়েছে।’

জানা যায়, ২০১০ সালের ২৩ এপ্রিল স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের গুলশান শাখায় হিসাব খোলে জারা কম্পোজিট টেক্সটাইল। ওই বছরের ৩০ মে প্রতিষ্ঠানটির জন্য ৫৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা ঋণ অনুমোদন করে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকে থাকা প্রতিষ্ঠানটির ৩২ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঋণ পরিশোধ করে ঋণটি কিনে নেয় স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। যদিও ওই সময়ে ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণের লেনদেন নিয়মিত ছিল না। ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের পাশাপাশি নতুন করে অর্থায়ন করা হলেও প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে কোনো জামানত নেওয়া হয়নি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে এসেছে, ঋণের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি ন্যাশনাল ব্যাংকে যে জামানত দিয়েছিল সেখানে তিনটি কবরকেও জামানত হিসেবে রাখা হয়েছিল। জামানতসহ সেই ঋণ পরে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক কিনে নেওয়ায় জামানতও তাদের হয়ে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ থেকে ২০১২ সালে জারা কম্পোজিট রপ্তানি আদেশের বিপরীতে বেশ কিছু ঋণপত্র খুললেও কোনো পণ্য রপ্তানি হয়নি। ফলে গ্রাহকের নতুন ঋণ সৃষ্টি করে স্থানীয় দেনা সমন্বয় করে ব্যাংক। ২০১২ সালের ৫ আগস্ট স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের পর্ষদ এ ঋণের মেয়াদ বৃদ্ধি করে ১৫ বছর পুনর্নির্ধারণ করে। এরপরও নতুন করে অর্থায়ন করা হয়। ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর এসে জারা কম্পোজিট কর্তৃপক্ষ ঋণ পরিশোধে অপারগতা জানিয়ে সুদ মওকুফের জন্য চিঠি দেয়। এরপর ৩০ ডিসেম্বরের পর্ষদ সভায় ৪৪ কোটি টাকার ঋণকে সুদমুক্ত ঋণসুবিধা দেওয়া হয়। এ ছাড়া ৭২ কোটি ১৮ লাখ টাকার ঋণকে ১০ বছর মেয়াদি ঋণ পুনর্বিন্যাস সুবিধা দেওয়া হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১৫ ও ২০১৬ সালে পুরো ঋণটি খেলাপি করার নির্দেশ দিলেও ব্যাংকটি তা পরিপালন করেনি। ঋণটি খেলাপি হয়ে পড়লে ২০১৬ সালের ২৫ মে পুরো ঋণ পুনঃতফসিল করে ব্যাংক। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনাপত্তি না পাওয়ায় তা বাস্তবায়ন হয়নি। অর্থ আদায়ে এখন আইনি পথে হাঁটছে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক।

ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন-অর রশিদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঋণটি আদায় না হওয়ায় খেলাপি হয়ে পড়েছে। অর্থ আদায়ে আমরা আইনি পথে হাঁটছি। মামলা করা হয়েছে, আরও হবে।’

মামুন-অর রশিদ বলেন, ‘আমার মেয়াদে এ প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে কোনো সুবিধা দেওয়া হয়নি। যা হয়েছে আগের সময়ে। গ্রাহককে ঋণের চাপ থেকে স্বস্তি দিতেই কিছু সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। আর কবরস্থানকে জামানত দেখানোর যে অভিযোগ তুলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, তা সঠিক না।’

প্রতিষ্ঠানটির নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জারা কম্পোজিটের ১ লাখ শেয়ারের মধ্যে ৩৪ হাজার শেয়ারের মালিক ছিলেন জিয়াউদ্দিন বাবলু। ২০১৩ সালের ২০ জানুয়ারি তিনি পুরো শেয়ার প্রতিষ্ঠানের বর্তমান কর্ণধার বদরুল আহসানের স্ত্রী কামরুন নাহারের নামে হস্তান্তর করে দেন। ফলে ২০১৩ সালের আগ পর্যন্ত যেসব সুবিধা দেওয়া হয়েছিল, তখন জিয়াউদ্দিন বাবলু ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম পরিচালক।

এ বিষয়ে গতকাল জিয়াউদ্দিন বাবলুর সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।