ব্যাংকের সরকারি সেবায় মাশুল

  • ৮টি রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি
  • ব্যাংকগুলোর বিনা মূল্যে দেওয়া সরকারি সেবার বিপরীতে মাশুল নেওয়ার চিন্তাভাবনা

রাষ্ট্রমালিকানাধীন আট ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বাড়ছেই। গত বছরের সেপ্টেম্বরে এসব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে গত ডিসেম্বরে এই ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি অর্থ মন্ত্রণালয়ও চিন্তিত।
ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণে সরকারকে প্রতিবছরই বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হয়। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরেও রাখা হয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা, যা এখন বিতরণের অপেক্ষায়। ব্যাংকের গুরুতর প্রয়োজন বুঝে বাজেটের মাধ্যমে দেওয়া হবে জনগণের টাকা। ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণে জাতীয় বাজেটে টাকা রাখার চর্চাটি শুরু হয় ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে। ব্যাংক খাতে বড় কেলেঙ্কারিগুলোও শুরু হয় ওই বছর থেকেই।
সমাধানের পথ বের করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ গতকাল বুধবার সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) নিয়ে সচিবালয়ে বৈঠক করেছে। এতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. ইউনুসুর রহমান সভাপতিত্ব করেন।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, এক সোনালী ব্যাংকের কারণেই রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মোট মূলধন ঘাটতি অল্প সময়ের ব্যবধানে এত বেড়েছে। এই ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি যেখানে গত সেপ্টেম্বরে ছিল ৩ হাজার ১৩০ কোটি টাকা, সেখানে তা বেড়ে ডিসেম্বরে হয়েছে ৬ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা।
কিন্তু ব্যাংকগুলোর জন্য যত টাকা বাজেটে রাখা হচ্ছে, সে তুলনায় মূলধন ঘাটতি পূরণের চাহিদা ১০ গুণ বেশি। এভাবে দেশের গরিব মানুষের করের টাকায় মূলধন ঘাটতি মেটানো হয় বলে সমালোচনাও রয়েছে। তবে আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য বাজেটে টাকা বরাদ্দ না-ও রাখা হতে পারে। বদলে বিকল্প পথ খুঁজছে সরকার। সেটি হচ্ছে ব্যাংকগুলো বর্তমানে সরকারের যেসব সেবা বিনা মূল্যে দিয়ে থাকে, তা আর বিনা মূল্যে দেবে না।
বৈঠক শেষে ইউনুসুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, ‘বেসরকারি ব্যাংকের তুলনায় রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে বেসরকারি ব্যাংক কোনো সেবাই বিনা মূল্যে দেয় না। আর রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো বিনা মূল্যে অন্তত ২৭ ধরনের সেবা দেয়। তাই বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এবং সেবার বদলে ব্যাংকের মাশুল নেওয়ার ব্যাপারে প্রাথমিক মত এসেছে।’
এর আগে মূলধন ঘাটতি পূরণে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ মিলে চারটি উপায় বের করেছিল। এগুলো হচ্ছে সরাসরি নগদ মূলধন সরবরাহ, বন্ড প্রচলন, বোনাস শেয়ার ছাড়া এবং খেলাপি ঋণ কমানো। এগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে অবশ্য গতকালের বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানা গেছে।
এদিকে হতদরিদ্র ও পেনশনভোগীদের সামান্য ভাতা দেওয়ার বিনিময়ে মাশুল নেওয়ার উদ্যোগ সমর্থনযোগ্য নয় বলে জানান সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর বরাদ্দ এমনিতেই প্রতিবছর কমছে। তার ওপর গরিবদের থেকে মাশুল নেওয়ার চিন্তা হবে ভুল উদ্যোগ, বরং ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ে মনোযোগী হওয়া উচিত।’
মির্জ্জা আজিজ আরও বলেন, ‘সব তালগোলে লাগছে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো নিজেরাই মূলধন ঘাটতিতে আছে। তাদের দিয়ে আবার বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।’
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মূলধন ঘাটতি পূরণে প্রথম ২০১১-২০১২ অর্থবছরে রাখা হয় ৩৪১ কোটি টাকা। পরের ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা রাখা হলেও ওই অর্থবছরে শেষ পর্যন্ত দেওয়া হয় ৫৪১ কোটি টাকা। ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য বরাদ্দ রাখা হয় ৪২০ কোটি টাকা। কিন্তু সরকার ওইবার খরচ করে প্রায় ১২ গুণ বেশি, পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও শেষ পর্যন্ত খরচ হয় ৫ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এই খাতে পাঁচ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়। তবে ওই অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা করা হয়। ২০১৬-১৭ এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছর দেওয়া হয় ২ হাজার কোটি টাকা করে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ পর্যালোচনা করে দেখেছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির অন্যতম কারণ বহুল আলোচিত হল-মার্ক কেলেঙ্কারি। এ কারণে সরকার ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সোনালী ব্যাংককে ২ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা দিয়েছে। বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেঙ্কারির ক্ষতি মেটাতে জনতা ব্যাংকও টাকা পেয়েছে। আর বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির পর এই ব্যাংককে সরকার প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা দিয়েছে।
বিশেষায়িত ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূলধন ঘাটতি বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের (বিকেবি), ৭ হাজার ৮৩ কোটি টাকা।
অগ্রণী ব্যাংকের এমডি শামস-উল-ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, তাঁর ব্যাংকে কোনো মূলধন ঘাটতি নেই। আর সেবা মাশুলের বিষয়টি একান্তই সরকারের সিদ্ধান্ত।