কবে উড়বে বিমান

২২ বছরেও বগুড়া বিমানবন্দরে বাণিজ্যিকভাবে বিমানসেবা চালু হয়নি। বাণিজ্যিক বিমানের পরিবর্তে বর্তমানে সেখানে চলছে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ স্কুলের কার্যক্রম। শিল্পোদ্যোক্তাসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ দ্রুত বগুড়ায় বাণিজ্যিক বিমান চালুর জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন।

জানা গেছে, বাণিজ্যিক বিমান চালুর জন্য নব্বইয়ের দশকে বগুড়া সদর উপজেলার এরুলিয়া এলাকায় প্রায় ১১০ একর জায়গাজুড়ে ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর নির্মাণ করা হয়। কিন্তু লোকসানের আশঙ্কায় সে সময় এ বিমানবন্দরটি আর চালু হয়নি।

সর্বশেষ গত বছরের ২৬ জুলাই ঢাকায় অনুষ্ঠিত জেলা প্রশাসক সম্মেলনে বগুড়ায় বাণিজ্যিকভাবে বিমানসেবা চালুর দাবি ওঠে। এ জন্য আরও ১০০ একর জমি অধিগ্রহণের খসড়া প্রস্তাবসহ প্রশাসনিক অনুমোদনের জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়। রানওয়ে সম্প্রসারণ, তেল সংরক্ষণাগার নির্মাণ এবং যাত্রী ও মালামাল ওঠানো-নামানোসহ অন্যান্য অবকাঠামো তৈরির জন্য এ জমি চাওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এস এম জাকির হোসেন বলেন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন পেলেই রানওয়ের জন্য জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হবে।

বগুড়ায় বাণিজ্যিক বিমানসেবা চালুর জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন জেলার ব্যবসায়ীদের সংগঠন শিল্প ও বণিক সমিতিসহ শিল্পোদ্যোক্তারা। স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক মানের খেলা আয়োজন করার জন্যও এ এলাকায় বিমানবন্দরটি চালু হওয়া দরকার।

জানতে চাইলে বগুড়ার শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি মো. মাছুদুর রহমান বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-অর্থনীতি, কৃষিসহ সব দিক থেকে এগিয়ে বগুড়া। নতুন শিল্পোদ্যোক্তারাও এখানে শিল্প স্থাপনে এগিয়ে আসছেন। অর্থনৈতিক অঞ্চলও হচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনা আরও বাড়ছে। এসব সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বাণিজ্যিক বিমানসেবা চালু করা জরুরি।

মাছুদুর রহমান বলেন, সড়কপথে ঢাকা থেকে বগুড়া আসতে ১০ ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। পথের ভোগান্তির কারণে বগুড়ায় কোনো বিদেশি ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী ও রপ্তানিকারকেরা আসতে চান না। বিদেশি ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তা না এলে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন তেমন কাজে আসবে না। তা ছাড়া অনেক মানুষ এখন বগুড়া থেকে সড়কপথে ঢাকায় যাতায়াত করতে চান না। তাঁরা বিমানে চলতে চান।

শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামের ভেন্যু ব্যবস্থাপক জামিলুর রহমান বলেন, এ স্টেডিয়াম আইসিসি থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভেন্যুর মর্যাদা পেয়েছিল। ক্রিকেটারদের যাতায়াতের সমস্যাসহ নানা কারণে এ ভেন্যুতে দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক কোনো ম্যাচ হচ্ছে না। এখন আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজন করতে গেলে নতুন করে আইসিসির কাছ থেকে স্বীকৃতি নবায়ন করতে হবে। বিমানসেবা চালু ছাড়া কোনোভাবেই তা আদায় করা সম্ভব না।

বগুড়ায় হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ী ও পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৫ হাজার বিদেশি ও পর্যটক বগুড়ায় আসেন। বাংলার প্রাচীন রাজধানী মহাস্থানগড়সহ দর্শনীয় ও ধর্মীয় একাধিক ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে। চেম্বারের তথ্য অনুযায়ী, এ জেলায় সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ছোট-বড় প্রায় ২০টি শিল্প-কারখানা রয়েছে। এসব শিল্প-কারখানার মধ্যে রয়েছে—ওষুধ খাতের প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগস ও ওয়ান ফার্মাসিউটিক্যালস, খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সকম কনজ্যুমার প্রোডাক্ট, মোটরসাইকেল সংযোজন প্রতিষ্ঠান উত্তরা মোটরস, এবিসি টাইলস, পেপার ও পার্টিকেল বোর্ডের কারখানা। এ ছাড়া বগুড়ায় চার তারকা মানের হোটেল রয়েছে দুটি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাণিজ্যিকভাবে বিমানসেবা চালুর মতো সব ধরনের অনুকূল পরিবেশ বগুড়ায় বিদ্যমান।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বগুড়ায় বিমানবন্দর স্থাপনের জন্য ১৯৮৭ সালে সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে সে সময় তা নানা জটিলতায় আটকে যায়। পরে ১৯৯১-৯৬ মেয়াদে বিএনপি সরকারের শেষ দিকে এখানে বিমানবন্দর স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। এ জন্য ২২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন হয়। ১৯৯৫ সালে সদর উপজেলার এরুলিয়া এলাকায় বগুড়া-নওগাঁ মহাসড়কের পাশে ১০৯ দশমিক ৮১ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রকল্পের আওতায় রানওয়ে, কার্যালয় ভবন ও কর্মকর্তাদের জন্য আবাসিক ভবন নির্মাণ, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ, রাস্তাঘাট নির্মাণসহ প্রয়োজনীয় সব অবকাঠামো নির্মাণ শুরু হয়। ২০০০ সালের দিকে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। কিন্তু  বাণিজ্যিকভাবে বিমান আর ওড়েনি। পরে সেখানে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র চালু করা হয়। বর্তমানে সেখানে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ করছে।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনের (বিসিক) শিল্প মালিক সমিতির জেলা সভাপতি আইনুল হক বলেন, বগুড়া বিমানবন্দরে বাণিজ্যিক বিমানসেবা চালু হলে ব্যবসা-বাণিজ্যে সম্ভাবনার দুয়ার আরও বিস্তৃত হবে। খুলে যাবে। এখানে যোগাযোগ, পরিবেশ, পাইপলাইনে গ্যাসসহ নানা কারণে শিল্পের অনুকূল পরিবেশ বিরাজমান আছে। শুধু বিমানযোগাযোগ সুবিধা না থাকায় বিদেশি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না।

বগুড়া জেলা প্রশাসনসূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি বগুড়া বিমানবন্দরে বাণিজ্যিক বিমানসেবা চালুর সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। তারা এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনও সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়েছে। কিন্তু কোনো অগ্রগতি নেই।

জেলা প্রশাসক মো. নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের প্রশাসনিক অনুমোদনের চিঠি এখনো পাওয়া যায়নি। চিঠি পাওয়ামাত্র ভূমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

কিছুদিন আগে সাবেক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বগুড়ার শহরতলিতে বেসরকারি সংস্থা টিএমএসএস পরিচালিত আন্তর্জাতিক মানের হোটেল ‘মম ইন লিমিটেডে’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন, পুণ্ড্রবর্ধন নগরবিধৌত বগুড়া হাজার বছরের সভ্যতা লালন করে। এ এলাকায় পর্যটনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে।

টিএমএসএসের নির্বাহী পরিচালক হোসনে আরা বেগম বলেন, উত্তরাঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র বগুড়া। এখানকার মহাস্থানগড়ে বিদেশি পর্যটকেরা আসতে চান। কিন্তু সড়কপথে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা বাসে করে আসতে তাঁরা উৎসাহ হারান। বিমান সেবা চালু হলে যোগাযোগ উন্নত হবে। তখন মানুষ সহজে বগুড়ায় আসতে পারবে।