মার্কিন-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি ইস্পাত আমদানিতে বড় অঙ্কের শুল্ক আরোপ করেন, তাহলে তা হবে বেইজিংয়ের বুক তাক করে গুলি ছোড়ার মতো। কিন্তু এর প্রভাব যে শুধু চীনের ওপর পড়বে তা নয়, দেশটি ইস্পাত আমদানি সীমিত করলে বা তাতে শুল্ক আরোপ করলে কানাডা, ব্রাজিল, দক্ষিণ কোরিয়া ও রাশিয়া আক্রান্ত হবে। তখন এর প্রভাব পুরো বাণিজ্যব্যবস্থায় ছড়িয়ে পড়বে। 
যুক্তরাষ্ট্রের দেশীয় ইস্পাতশিল্প চাঙা করতে ট্রাম্পের ডেস্কে বেশ কিছু প্রস্তাব জমা পড়ে আছে। দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রেসিডেন্টের কাছে যে সুপারিশ পাঠিয়েছে, তাতে ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের আমদানি পণ্যের ওপর সব রকম শুল্ক আরোপের সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশে নির্দিষ্ট কিছু দেশের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দিয়েছে তারা। অন্যদিকে কী পরিমাণ ইস্পাত আমদানি করা হবে তার সীমা নির্ধারণেও প্রস্তাব দিয়েছে।
এপ্রিলের আগ পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এর যেকোনো একটি অথবা মিশ্র ব্যবস্থা বেছে নিতে হবে। অথবা তিনি একদম ভিন্ন কিছুও করতে পারেন। অন্যদিকে অ্যালুমিনিয়ামের ব্যাপারেও তাঁর দপ্তরে একই প্রস্তাব এসেছে। 
এর আগে ট্রাম্পের ইস্পাত নিয়ে বাগাড়ম্বরের লক্ষ্য ছিল চীন। ক্ষমতা গ্রহণের পর ট্রাম্প চীনের সমালোচনা করেছিলেন এ জন্য যে দেশটি বৈশ্বিক বাজারে সস্তায় অতিরিক্ত ইস্পাত সরবরাহ করে। সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে না। 
নির্বাচনী প্রচারণা পর্বে ট্রাম্প পিটসবার্গের এক সমাবেশে বলেছিলেন, ‘ঠিক আছে, চীন যুক্তরাষ্ট্রের সব জায়গা সস্তা ইস্পাতে ভরিয়ে দিচ্ছে। আমরা হয়তো একটু সস্তায় ইস্পাত পাচ্ছি, কিন্তু পরিণামে আমাদের বেকারত্ব বাড়ছে।’ এটা ঠিক যে চীন বিশ্বের শীর্ষ ইস্পাত রপ্তানিকারক, বাজারে তাদের কারণেই অতিরিক্ত সরবরাহ আছে, যে কারণে দাম পড়ে গেছে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের ইস্পাত ব্যবসায়ীরা এত দিন ট্রাম্পের সুরেই কথা বলে এসেছেন। 
তবে ট্রাম্প এত কিছু বললেও চীন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ১০ ইস্পাত সরবরাহকারীর তালিকায়ও নেই। ওবামা প্রশাসন চীনা ইস্পাত আমদানির ওপর যে জরিমানা আরোপ করেছিল সে কারণে দেশটিতে চীনা ইস্পাতের রপ্তানি কমে যায়। যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি ইস্পাত আমদানি করে কানাডা থেকে, যার পরিমাণ ১৬ শতাংশ। এ ছাড়া সে ব্রাজিল থেকে আনে ১৩ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১০ শতাংশ এবং মেক্সিকো ও রাশিয়া থেকে আনে ৯ শতাংশ। অর্থাৎ ইস্পাত আমদানির ওপর যে ২৪ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব আছে তা বাস্তবায়িত হলে পৃথিবীর অনেক দেশই আক্রান্ত হবে।
বাণিজ্য বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্প যদি এই পথে হাঁটেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র যেমন: কানাডা, দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো প্রভৃতি দেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাদের আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করতে পারে। অথবা তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পণ্য নাও কিনতে পারে।
জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষক মাইকেল মুর বলেছেন, ‘অভ্যন্তরীণ খাতকে সুরক্ষা দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অংশীদারদের বিরক্ত করা—এ দুটির মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য রাখা উচিত।’
এই পরিস্থিতিতে ট্রাম্প যদি প্রত্যাশামতো ট্রেড এক্সপ্যানশন অ্যাক্টের ২৩২ ধারা প্রয়োগ করেন, তাহলে বলতে হয় তিনি বিশ্বাস করেন, ইস্পাত আমদানি জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই যুক্তি ঠুনকো। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আপস-মীমাংসায় তা টিকবে না। ফোর্ডহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ ম্যাট গোল্ড বলেছেন, ‘আমরা যদি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আইনের গুরুতর লঙ্ঘন করি তাহলে তা বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থার ভিত নাড়িয়ে দেবে।’ 
চীনের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্র বেশি ইস্পাত না কিনলেও ঘুরপথে চীনের অনেক ইস্পাত যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকে—তাই যুক্তরাষ্ট্রের এই সুরক্ষা নীতি বাস্তবায়িত হলে চীনের অনেক ক্ষতি হবে।