বড় অর্জনে চ্যালেঞ্জও অনেক বেশি

স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশ হলে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের বাজারসুবিধা সংকুচিত হতে পারে। দাতাদের কাছ থেকে কম সুদে ঋণ পাওয়ার সুযোগও কমে যাবে। তাই অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সম্পদ বৃদ্ধির দিকেই বেশি মনোযোগী হতে হবে। আবার অভ্যন্তরীণ বাজার চাঙা করতে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের আয় বাড়াতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে কাটাতে হবে অবকাঠামো দুর্বলতা। জোর দিতে হবে দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরিতে। 

জাতিসংঘের সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) ঘোষণা দিয়েছে যে এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের শর্ত হিসেবে তিনটি সূচকেই নির্ধারিত মান অর্জন করেছে বাংলাদেশ। তবে এই উন্নতির ধারাবাহিকতা আরও তিন বছর বজায় রাখতে হবে। এরপর ২০২১ সালে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল (ইকোসোক) স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা উত্তরণের সুপারিশ করবে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অনুমোদনের জন্য আরও তিন বছর অর্থাৎ ২০২৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বাংলাদেশকে। এরপরই উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জাতিসংঘের তালিকায় থাকবে।
প্রথমবারের মতো উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যোগ্যতা অর্জন করার খবরটি বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হিসেবে মনে করা হচ্ছে। ১৯৭৬ সালে এলডিসিভুক্ত হওয়ার পর এই প্রথম অর্থনৈতিক উন্নতির বড় ধরনের স্বীকৃতি পেল বাংলাদেশ। এর আগে ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের তালিকায় নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে আগামী ৯ বছরে বাজারসুবিধায় তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। ২০২৭ সাল পর্যন্ত শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা থাকবে। ওষুধশিল্পের মেধাস্বত্ব সুবিধা ২০৩৩ সাল পর্যন্ত থাকবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, দাতাদের কাছ থেকে যেহেতু রেয়াতি সুদে ঋণ প্রাপ্তি কমে যাবে, তাই বিকল্প অর্থায়নের দিকে জোর দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে কর আহরণ বৃদ্ধি করতে হবে। তিনি আরও বলেন, যেসব দেশ এলডিসি থেকে বের হয়েছে, তাদের বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কী হয়, তা দেখার বিষয়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নীতি ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ওপর জোর দিতে হবে। তাঁর মতে, অর্থনীতিতে যে কাঠামোগত দুর্বলতা আছে, তা দূর করতে হবে। কেননা এমন এক সময় বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হবে, তখন বৈরী আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।

বাণিজ্যসুবিধা কতটা কমবে
স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বর্তমানে ইউরোপের ৪০টি দেশে অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা পায়। উন্নয়নশীল দেশ হলে এই সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার প্রশ্ন উঠবে। তবে একতরফা, তাৎক্ষণিকভাবে এই সুযোগ শেষ হবে না, আলোচনার মাধ্যমেই সিদ্ধান্ত হবে। দর-কষাকষির মাধ্যমে জিএসপি প্লাসে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
প্রতিযোগীসক্ষম হলে যে টিকে থাকা যায়, এর অভিজ্ঞতাও বাংলাদেশের আছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা উঠে গেলেও বেশ ভালোভাবেই টিকে আছে বাংলাদেশ। তবে রপ্তানি খাত এক পণ্যনির্ভর না হয়ে তৈরি পোশাকের মতো বিকল্প পণ্য তৈরি করার দিকে মনোযোগী হতে হবে।

রেয়াতি ঋণসুবিধা পাবে না
এলডিসি হওয়ার কারণে প্রত্যক্ষভাবে দাতাদের দেশগুলোর কাছে রেয়াতি সুবিধা পায় না বাংলাদেশ। তবে কম মাথাপিছু আয়ের দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাংকের ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইডিএ) থেকে মাত্র দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে ঋণ পায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে যাওয়ায় আগামী বছর থেকে আইডিএ জিএপি দেশ হিসেবে বিবেচিত হবে। তখন বাংলাদেশ আর দশমিক ৭৫ শতাংশ বা রেয়াতি সুদে ঋণ পাবে না। আইডিএ জিএপি দেশ হিসেবে সুদের হার পড়বে প্রায় আড়াই শতাংশ। যেহেতু উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় আর বেড়ে চলেছে, তাই ঋণের সুদের হারও বাড়বে। তবে বাড়তি সুদে ঋণ নেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। বাংলাদেশ যদি কোনো প্রকল্প সঠিকভাবে বিশ্বব্যাংকের কাছে উপস্থাপন করতে পারে, তখন যত খুশি ঋণ নিতে পারবে।
মাথাপিছু আয় বেড়ে যাওয়ার কারণে ইতিমধ্যে এডিবির কাছ থেকে সীমিত পরিসরে বেশি সুদের ঋণ নেওয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এলডিসি থেকে বের হওয়া বাংলাদেশের জন্য একটি সুযোগ। আরও বেশি অর্থ পাওয়ার জানালা খুলবে। যখন বাংলাদেশ বেশি সুদে ঋণ নেবে, তা আসলে বাংলাদেশের অর্থনীতির সক্ষমতার প্রকাশ ঘটবে। আন্তর্জাতিক বাজারে সার্বভৌম বন্ড ছেড়ে অর্থ আহরণের সুযোগও তৈরি হবে।

সুরক্ষার ক্ষমতা কমতে পারে
স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নিজের অভ্যন্তরীণ শিল্প সুরক্ষায় সম্পূরক শুল্ক, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বসানোসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু এলডিসি থেকে বের হয়ে গেলে এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ সংকুচিত হতে পারে। ফলে বাংলাদেশের শিল্পকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। আবার রাজস্ব আহরণেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সম্পূরক শুল্ক, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক থেকে মোট রাজস্বের বড় অংশ আসে। গত অর্থবছরে শুধু সম্পূরক শুল্ক থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা আদায় করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও জাহিদ হোসেন উভয়েই বেশ কিছু বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। যেমন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে অবকাঠামো উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করা, শ্রমশক্তির মানোন্নয়ন।