সাংসদদের জন্য ভোটের বছরে আরও প্রকল্প

জাতীয় সংসদ ভবন
জাতীয় সংসদ ভবন
>
  • এবার মাদ্রাসা নির্মাণে বরাদ্দ
  • ছয়টি করে মাদ্রাসা ভবন তৈরি করবেন প্রত্যেক সাংসদ
  • সারা দেশে ২ হাজার মাদ্রাসা ভবন নির্মাণ করা হবে
  • ব্যয় ৭ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা
  • প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে ২০২০ সালে

ভোটের বছরে স্কুল ভবনের পর এবার নিজের এলাকায় মাদ্রাসা ভবন নির্মাণের সুযোগ পাচ্ছেন সাংসদেরা। প্রত্যেক সাংসদ অন্তত ছয়টি করে মাদ্রাসা ভবন তৈরি করবেন। এর বাইরে মন্ত্রীদের জন্য বরাদ্দ থাকবে আরও ২০০ মাদ্রাসা নির্মাণের টাকা। পুরো প্রকল্পটিতে খরচ হবে ৭ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা।

নির্বাচনের বছরে জাতীয় সংসদের সাংসদদের জন্য এই প্রকল্পটিসহ মোট তিন প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে জমা আছে। তিন প্রকল্পে খরচ হবে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। পরিকল্পনা কমিশন এখন প্রকল্পগুলো যাচাই-বাছাই করছে। অন্য দুটি প্রকল্পের একটি হলো, নিজের এলাকায় গভীর নলকূপ ও গণশৌচাগার নির্মাণ। অপরটি হলো, হাটবাজারের অবকাঠামো উন্নয়ন ও সংস্কার। স্থানীয় সাংসদেরা ঠিক করে দেবেন কোথায় গভীর নলকূপ, গণশৌচাগার ও হাটবাজার হবে।

এর আগে অবশ্য চলতি অর্থবছরেই সাংসদদের জন্য আরও তিনটি প্রকল্প পাস করা হয়। এসব প্রকল্পে সাংসদদের ইচ্ছায় নতুন স্কুল ভবন, মসজিদ-মন্দির নির্মাণ করা হবে।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এটি সাংসদের নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ করার শামিল। এই ধরনের প্রকল্পের সুবিধা ভোগ করবে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল। ভোটের বছরে ভোটার তুষ্টির জন্যই এসব প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। সাংসদেরা যাতে নিজেদের ভোট ব্যাংক তৈরি করতে পারেন। নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে সামনে রেখে এসব উন্নয়ন হচ্ছে। আবার এসব প্রকল্পে কাজ পাবেন সাংসদের নিজস্ব লোকেরাই।

তোফায়েল আহমেদ আরও বলেন, স্কুল-মাদ্রাসা নির্মাণের জন্য নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয় আছে। এখানে সাংসদদের অন্তর্ভুক্ত করা সংবিধান পরিপন্থী। নির্বাহী কাজ করা সাংসদদের দায়িত্ব নয়; কোথাও কোনো অনিয়ম হলে তাঁরা সংসদে প্রশ্ন তুলবেন। সাংসদদের জন্য প্রকল্প নেওয়ার ফলে বাজেটের আর্থিক শৃঙ্খলাও নষ্ট হচ্ছে।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, গত জানুয়ারি মাসে মাদ্রাসা নির্মাণের প্রকল্প প্রস্তাবটি পরিকল্পনা কমিশনে আসে। এই প্রকল্পে প্রত্যেক সাংসদ নিজের এলাকার কোন ছয়টি মাদ্রাসার জন্য নতুন ভবন নির্মাণ করতে হবে, তা ঠিক করে দেবেন। সাংসদদের চাহিদা অনুযায়ী মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর সেসব মাদ্রাসা ভবন নির্মাণ করে দেবে। স্থানীয় ঠিকাদারেরাই এসব কাজ পাবেন। গত জানুয়ারি মাস থেকে শুরু হয়ে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২০ সালের জুন মাসে শেষ হবে।

এই প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে ২ হাজার মাদ্রাসা ভবন নির্মাণ করা হবে। ভবন নির্মাণের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি ল্যাবরেটরিসহ আধুনিক সুবিধা থাকবে। প্রতিটি ভবন হবে পাঁচতলা, নিচতলা ফাঁকা থাকবে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পরিকল্পনা কমিশনে অনুষ্ঠিত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়। শিগগিরই তা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উঠছে।

 পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দেশের বাস্তবতা হলো, সাংসদেরা শুধু আইননির্ভর নন; তাঁরা উন্নয়ননির্ভর। সাংসদদের কাছে উন্নয়ন প্রত্যাশা করেন সাধারণ মানুষ। আবার সাংসদদেরও ভোটের জন্য জনগণের কাছে যেতে হয়। এসব বিবেচনায় সাংসদদের জন্য যেসব প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, তা খারাপ কিছু নয়। তবে প্রকল্পগুলো যথাযথভাবে হচ্ছে কি না, সঠিকভাবে খরচ হচ্ছে কি না, তা তদারকিতে রাখা দরকার।’

জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই বিভিন্ন আসনের সাংসদেরা নিজের এলাকায় মাদ্রাসা ভবন নির্মাণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ডিও (ডিমান্ড অব অর্ডার) দেন। ওই সব চিঠিতে তাঁরা নিজেদের এলাকার মাদ্রাসা ভবনগুলোর দৈন্যদশা ও জরাজীর্ণ অবস্থার কথা তুলে নতুন ভবন নির্মাণের আবেদন করেন। সাংসদদের চাহিদার ভিত্তিতে নতুন মাদ্রাসা ভবন নির্মাণের জন্য প্রকল্প নেয় সরকার। এ বছরের শুরুতে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর এই প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে পরিকল্পনা কমিশনে জমা দেয়। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, যেহেতু প্রকল্পের টাকা মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের বাজেট থেকে দেওয়া হবে। তাই সম্প্রতি প্রকল্পের দায়িত্ব মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরকে দেওয়া হয়।

এই বিষয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বিল্লাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে সাংসদদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সাংসদেরাই ঠিক করে দেবেন ওনার আসনের কোন কোন মাদ্রাসায় নতুন ভবন লাগবে। আমরা শুধু ভবন নির্মাণ করে দেব। একনেকে প্রকল্প অনুমোদন হলেই দ্রুততম সময়ে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করা হবে।

সাংসদদের মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়ার আরও দুটি প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে জমা আছে। একটি প্রকল্পে প্রত্যেক সাংসদের নিজের এলাকার জন্য নলকূপ ও পাবলিক টয়লেট (গণশৌচাগার) নির্মাণের জন্য গড়ে ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। ওই প্রকল্পে মোট ব্যয় হবে ৯০৩ কোটি টাকা। গ্রামীণ বাজার অবকাঠামো উন্নয়ন শীর্ষক আরেকটি প্রকল্পে সাংসদেরা নিজের এলাকায় পছন্দমতো হাটবাজার উন্নয়নে বরাদ্দ পাবেন। মূলত বাজারগুলোতে পাকা ভবন ও আনুষঙ্গিক আধুনিক সুবিধাদি নিশ্চিত করা হবে। ওই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে মোট ১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা।

 পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে লোকসভা ও রাজ্যসভার সদস্যদের তাঁদের এলাকার উন্নয়নে কেন্দ্রীয় সরকার বরাদ্দ দেয়। রাস্তাঘাটসহ জনকল্যাণমূলক অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। কিন্তু পার্থক্য হলো, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ভারতে প্রতিটি রুপির ব্যয় বিবরণী প্রতি মাসেই হালনাগাদ করতে হয়। বরাদ্দ করা অর্থ কোথায় কত খরচ হলো, মাস শেষে এর বিবরণী ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। মূলত সাংসদদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের জবাবদিহি নিশ্চিত করতেই এমন বিবরণী প্রকাশ করে ভারতের কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান বিভাগ। সর্বশেষ হিসাবমতে, ভারতের সব রাজ্যে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১ হাজার ৭১ কোটি রুপি খরচ হয়েছে। এই অর্থবছরে বরাদ্দ আছে ৩ হাজার ৯৫০ কোটি রুপি।

 সরকারি এমপিওভুক্ত মাদ্রাসাগুলো থেকে বাছাই করে এই প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন ভবন নির্মাণ করা হবে। এমপিওভুক্ত মাদ্রাসায় সরকারি তহবিল থেকে বেতন-ভাতা বাবদ মাসিক অনুদান দেওয়া হয়। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বেইনবেস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সাল পর্যন্ত দেশে দাখিল থেকে কামিল পর্যন্ত মোট মাদ্রাসা ৯ হাজার ৩১৪টি। ওই বছর ভর্তি হওয়া মোট শিক্ষার্থী ছিল ৩৮ লাখ ৩২ হাজার ২৯৩ জন।

 মাদ্রাসা ভবন নির্মাণের প্রকল্প সম্পর্কে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি প্রথম আলোকে বলেন, যদি এমন প্রকল্প পাস হয়, তবে তা গোটা জাতির জন্য আত্মঘাতী হবে, জাতিকে পেছনে টেনে ধরবে। আমাদের একমুখী আধুনিক শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। আমার জানামতে, কোনো মহল থেকেই এই ধরনের মাদ্রাসা ভবন নির্মাণের দাবি করা হয়নি। তিনি আরও বলেন, দেশের স্কুলগুলোর দৈন্যদশা। ক্লাসরুম নেই, লাইব্রেরি নেই। তাই সাধারণ শিক্ষার ওপর বেশি জোর দেওয়া উচিত।

সাংসদদের যত প্রকল্প

 চলতি অর্থবছরেই সাংসদদের জন্য আরও তিনটি প্রকল্প পাস করা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি পৃথক প্রকল্পে প্রত্যেক সাংসদ ১০টি বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুলের নতুন ভবন নির্মাণ এবং ১০টি অর্ধনির্মিত ভবনের কাজ শেষ করার বরাদ্দ পাচ্ছেন। অপর প্রকল্পের মাধ্যমে প্রত্যেক সাংসদ নিজের এলাকার মসজিদ-মন্দিরসহ ধর্মীয় উপাসনালয় উন্নয়নে এক কোটি টাকা বরাদ্দ পাচ্ছেন। এই তিন প্রকল্পে ১৬ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা খরচ হবে। এখনো নির্মাণকাজ শুরু হয়নি।

২০১০ সালে প্রথমবারের মতো সাংসদদের সরাসরি বরাদ্দ দিয়ে প্রকল্প নেওয়া শুরু করে সরকার। ওই বছর যে প্রকল্প পাস করা হয়, তাতে পরের পাঁচ বছর প্রত্যেক সাংসদ নিজের এলাকায় ১৫ কোটি টাকা রাস্তাঘাট নির্মাণের বরাদ্দ পেয়েছেন। দ্বিতীয় পর্যায় চলছে, ২০১৯ সালে শেষ হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রত্যেক সাংসদ ২০ কোটি টাকা পাচ্ছেন। তবে এই প্রকল্পটির কাজ কেমন চলছে, তা নিয়ে কখনোই পরিদর্শন করেনি বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে শেষ হওয়া বেশ কিছু প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন করেছে আইএমইডি। সেই তালিকায় প্রথম পর্যায়ের প্রকল্পটি নেই।