গ্রাহককে ১ টাকা ঠকাতে সহযোগী মোবাইল অপারেটররা

>
  • নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন নিয়েই ২৯, ৩৯, ৭৯ বা ১০৯ টাকার মোবাইল রিচার্জ ব্যবস্থা চালু করেছে অপারেটররা।
  • প্যাকেজের মূল্যে খুচরা পয়সার অভাব দেখিয়ে রিচার্জ ব্যবসায়ীরা ১ টাকা করে বেশি নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।

মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের রিচার্জে ১ টাকা করে ঠকাতে সহযোগীর ভূমিকা পালন করছে দেশের মোবাইল ফোন অপারেটররা। তারা এমন হারে প্যাকেজের মূল্য নির্ধারণ করছে, যেখানে খুচরা পয়সার অভাব দেখিয়ে রিচার্জ ব্যবসায়ীরা ১ টাকা করে বেশি নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এতে সাড়ে ১৪ কোটি মোবাইল ফোনসংযোগ থেকে গ্রাহকের পকেট কেটে কোটি কোটি টাকা বাড়তি আয়ের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে।

মোবাইল ফোনে সারা দিনরাত প্রতি সেকেন্ড ১ পয়সা দরে কথা বলার জন্য দেশের তিন বেসরকারি অপারেটরের একটি বিশেষ প্যাকেজ আছে। বিশেষ এ কলরেটে কথা বলার সুবিধা পেতে হলে গ্রাহকদের ২৯,৩৯, ৭৯ ও ১০৯ টাকা রিচার্জ করতে হয়। সুবিধাজনক হওয়ায় অনেক গ্রাহকই অপারেটরদের এ প্যাকেজ কেনেন। কিন্তু রিচার্জের দোকানে গিয়ে মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাধে বিপত্তি। কারণ, ২৯ বা ১০৯ টাকা রিচার্জ করলে বেশির ভাগ দোকানিই আর ১ টাকা গ্রাহককে ফেরত দেন না।

গ্রাহকেরা বলছেন, এই প্যাকেজের মূল্য যদি জোড় সংখ্যায় হতো, তাহলে এভাবে ১ টাকা ঠকতে হতো না। কিন্তু অভিযোগ আছে, রিচার্জ ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতেই মোবাইল ফোন অপারেটররা এ ধরনের প্যাকেজ ঘোষণা করছে। এ বিষয়টি টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনেরও (বিটিআরসি) জানা। তাদের অনুমোদন নিয়েই মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংক এ কাজ করছে। এমনকি সরকারের মালিকানাধীন মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটকেরও একই ধরনের প্যাকেজ আছে।

মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো প্রতি ১ হাজার টাকা রিচার্জে খুচরা ব্যবসায়ীদের ২৭ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ২৮ টাকা ৫০ পয়সা কমিশন দেয়। তবে টেলিটক প্রতি হাজারে ৩০ টাকা দেয়। অভিযোগ আছে, রিচার্জ ব্যবসায়ীদের যে হারে কমিশন দেওয়া হয়, সেটি যথেষ্ট নয়। এতে তাঁদের দোকানভাড়া, ব্যবসা পরিচালনা, কর্মচারীদের বেতন, ভুল নম্বরে টাকা পাঠানোর কারণে ক্ষতিপূরণ দেওয়াসহ নানা ব্যয় মেটানো কঠিন হয়। কিন্তু ১ টাকা বাড়তি নিয়ে তাঁরা মুনাফার ব্যবস্থা করেন।

মোবাইল ফোন রিচার্জ ব্যবসায়ী অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক বদরুদ্দোজা বলেন, ‘যে কমিশন আমরা পাই, বর্তমান বাজারের তুলনায় তা খুবই নগণ্য। কমিশন বাড়াতে আন্দোলনের পাশাপাশি এ বিষয়ে বিটিআরসি, এফবিসিসিআই ও মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটবে প্রস্তাব দিয়েছি আমরা, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।’

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান বলেন, মোবাইলে ২৯ টাকা, ৩৯ টাকা বা ১০৯ টাকা রিচার্জ করতে গেলে সাধারণত রিচার্জ ব্যবসায়ীদের দিতে হয় ৩০ টাকা, ৪০ টাকা বা ১১০ টাকা। অর্থাৎ মোবাইল ফোন অপারেটররাই রিচার্জ ব্যবসায়ীদের ১ টাকা বেশি নেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। এ ধরনের প্যাকেজ অফার রিচার্জভিত্তিক না হয়ে যদি নির্দিষ্ট কোড ডায়ালের মাধ্যমে হয়, তাহলে এ সমস্যা থাকে না।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে মোবাইল ফোন অপারেটররা বলছে, গ্রাহকদের বিভিন্ন ধরনের বান্ডেল বা গুচ্ছ সুবিধা দিতে এ ধরনের রিচার্জ ব্যবস্থা দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে ২৯ বা এ ধরনের অঙ্কের রিচার্জ করলে সরাসরি এসব সুবিধা চালু হয়। খুচরা ব্যবসায়ীদের বাড়তি সুবিধা দিতে এ ধরনের রিচার্জ ব্যবস্থা চালু করা হয়নি।

রবি আজিয়াটার ভাইস প্রেসিডেন্ট ও মুখপাত্র ইকরাম কবীর বলেন, প্রতিটি রিচার্জ ব্যবস্থাই গ্রাহককে নির্দিষ্ট কিছু সুবিধা দিতে তৈরি করা হয়। ২৯ বা ৩৯ টাকার পাশাপাশি রবির ৩৪ বা ৫৪ টাকার রিচার্জ সুবিধাও আছে। রবির নিজস্ব গ্রাহকসেবা কেন্দ্রে কখনোই কোনো সেবার জন্য বাড়তি অর্থ নেওয়া হয় না। আর প্রতিযোগীদের তুলনায় খুচরা রিচার্জকারীদের রবি সব সময় একটু বেশি কমিশন দেয়। তাই তাদের কমিশন কম দেওয়ার অভিযোগটি সঠিক নয়।

মোবাইল ফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকার ইলেকট্রনিক রিচার্জ করা হয়। সে হিসাবে প্রতি মাসে কমপক্ষে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়, বছরে যা দাঁড়ায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। প্রতিদিন ৫০ কোটি টাকার এ লেনদেনে কত টাকা গ্রাহককে অতিরিক্ত দিতে হয়, তার কোনো হিসাব নেই। ইলেকট্রনিক রিচার্জের বাইরে স্ক্র্যাচ কার্ড, ব্যাংকের মোবাইল ফোন হিসাব, ওয়েবসাইট, ক্রেডিট, ডেবিট কার্ডসহ আরও কয়েকটি উপায়ে মোবাইল ফোনে রিচার্জ করা যায়।

টেলিযোগাযোগবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার জ্যেষ্ঠ গবেষক আবু সাইদ খান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের মুদ্রা ব্যবস্থায় ১ টাকার নোট বা কয়েন মহার্ঘ বস্তু। ইচ্ছা করলেই এই রিচার্জ অফার যেকোনো জোড় সংখ্যায় নির্ধারণ করা যায়। পরিবেশক ও খুচরা ব্যবসায়ীদের অঘোষিত আর্থিক সুবিধা বা প্রণোদনা দিতেই মূলত এ কাজটি করা হয়। নিয়ন্ত্রণ সংস্থার অনুমোদন নিয়ে যেহেতু এ কাজ করা হয়, তাই এটি বেআইনি নয় কিন্তু অনৈতিক।