সোনালী ব্যাংকের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অভিনব সুযোগ

>
  • কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের নির্দেশে সোনালী ব্যাংককে ছাড়।
  • ছাড় পাওয়ায় এখন সোনালী ব্যাংক নিজেদের লাভজনক দেখাতে পারবে।

খেলাপি ঋণ কমাতে না পেরে অভিনব কৌশল নিয়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক। আর এ কাজে সহায়তা করছে স্বয়ং বাংলাদেশ ব্যাংক। মূলত আর্থিক অবস্থা ভালো দেখাতেই আয়োজন। এ জন্য নিরীক্ষার মূল নীতিকেই পাশ কাটাচ্ছে ব্যাংকটি।

আর যে সুবিধাটি সোনালী ব্যাংক পেয়েছে তা হলো ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতির যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে, ২০১৭ সালের আর্থিক হিসাবে তা পূরণ করতে হবে না। এ ছাড়া সরকারকে দেওয়া কর সমন্বয়েও ছাড় পেয়েছে ব্যাংকটি। এসব ছাড় না পেলে বড় ধরনের মূলধন ঘাটতিতে পড়ে বেহাল হতো ব্যাংকটি। কিন্তু ছাড় পাওয়ায় এখন সোনালী ব্যাংক নিজেদের লাভজনক ব্যাংক দেখাতে পারবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের নির্দেশেই সোনালী ব্যাংককে এ ছাড় দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পদে নিয়োগের সময় ফজলে কবির এই সোনালী ব্যাংকেরই চেয়ারম্যান ছিলেন।

ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা ঠিক রাখতে সারা বিশ্বেই ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়। মূলত মুনাফা থেকে এসব অর্থ রাখতে হয়। আর মুনাফা না হলে মূলধন থেকে সংরক্ষণ করতে হয়। ২০০৮ সালের বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দার পর এ ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়। বাংলাদেশেও ২০১২ সালে ঋণ শ্রেণীকরণ ও সঞ্চিতির নীতিমালা কঠোর করা হয়। এর ফলে যেকোনো ভালো ঋণের ক্ষেত্রেও কমপক্ষে ১ শতাংশ ও খেলাপি ঋণের বিপরীতে শতভাগ সঞ্চিতি রাখতে হয়। এতে ব্যাংকগুলোর মুনাফা কমলেও আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তা হয় জোরদার।

বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো পাঁচ বছর ধরেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এ সঞ্চিতি সংরক্ষণে খানিকটা ছাড় নিয়ে মুনাফা বাড়িয়ে দেখাচ্ছে। ব্যাংকগুলোকে এখন তিন বছরে সঞ্চিতি সংরক্ষণের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। আর এবার তো সোনালী ব্যাংককে পুরোপুরিই অব্যাহতি দেওয়া হলো। এভাবেই আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদিত হলে ব্যাংকটির বিশ্বাসযোগ্যতা সংকটে পড়বে বলে মনে করছেন হিসাববিদেরা।

এমন সুযোগ পেয়েছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘হ্যাঁ, পেয়েছি। আর্থিক প্রতিবেদন ভালো করতে এটা সাময়িক সমাধান। তবে আমরা চেষ্টা করছি ঘুরে দাঁড়াতে।’

ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ আরও বলেন, ‘আমরা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের এক লাখ কোটি টাকার ঋণপত্র খুলেছি। এতে পাঁচ হাজার কোটি টাকা মাশুল মিলত, কোনো টাকা পাইনি। এ ছাড়া সরকারের ৩৭টি সেবা বিনা মাশুলে দেওয়া হয়। এতে মাশুল নিলে কোনো মূলধন ঘাটতি থাকত না। এসব সুবিধার প্রয়োজন হতো না।’

সোনালী ব্যাংক সূত্রে পাওয়া অনিরীক্ষিত প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা গেছে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির ঋণ বিতরণ হয়েছে ৩৬ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৩ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিতরণ করা ঋণের ৩৮ শতাংশই খেলাপি। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির ঋণের বিপরীতে ৭ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণের প্রয়োজন পড়ে। তবে ব্যাংকটি সঞ্চিতি রাখতে পারে ৪ হাজার ২১২ কোটি টাকা। ওই সময়ে সঞ্চিতি ঘাটতি হয় ৩ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। এর ফলে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি বেড়ে হয় ৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা।

এ পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩১ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লেখা এক চিঠিতে সোনালী ব্যাংক জানায়, যে পরিমাণ সঞ্চিতি ঘাটতি রয়েছে, তা ২০১৭ সালে সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে না। এ ছাড়া আগে যেসব কর দেওয়া হয়েছে, তা মূলধন থেকে বাদ দেওয়ার অনুমতি চায় ব্যাংকটি। এরপরই কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদারহস্তে সোনালী ব্যাংকের সব চাহিদা পূরণ করে দেয়। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কেউ কথা বলতে চাননি।

এমন সুযোগের বিষয়ে সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদদের সংস্থা দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম এফসিএ প্রথম আলোকে বলেন, কোনো ব্যাংক খাদে পড়ে গেলে এসব সুযোগ দেওয়া হয়। তবে আন্তর্জাতিকভাবে এ আর্থিক প্রতিবেদন গ্রহণযোগ্য হয় না। এ ব্যাংকের সঙ্গে বিদেশি ব্যাংকগুলো সম্পর্ক রাখতেও আগ্রহ হারায়। এমন সুযোগ দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে খারাপ ধারণা দেয়। বিদেশিরা বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হয়।

আবদুস সালাম আরও বলেন, ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি না রাখাকে নিরীক্ষার আন্তর্জাতিক কোনো আইন সমর্থন করে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হয়নি এমন সুযোগ দেওয়া। অন্যভাবে বিষয়টি সমাধান করা যেত।