খেলাপি ঋণে কমেছে মুনাফা

>
  • আগের বছরের চেয়ে প্রকৃত মুনাফা কমেছে ১৩ ব্যাংকের
  • মুনাফা বেড়েছে ১৬ ব্যাংকের।
  • ২০১৭ সালে ব্যাংকগুলো ঋণ দিয়ে ভালো সুদ আয় করেছে।
  • তবে খেলাপি ঋণের চাপে সব ব্যাংক মুনাফা বাড়াতে পারেনি।

বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো ২০১৭ সালে ভালো ব্যবসা করলেও অনেক ব্যাংকের প্রকৃত বা নিট মুনাফা কমে গেছে। আবার কিছু ব্যাংক ২০১৬ সালের চেয়ে ভালো মুনাফা করতে পেরেছে। ফলে সব মিলিয়ে ২০১৭ সালে ব্যাংকগুলো ঋণ দিয়ে ভালো সুদ আয় করলেও খেলাপি ঋণের চাপে সব ব্যাংক মুনাফা বাড়াতে পারেনি।

আর খেলাপি ঋণের বিপরীতে চাহিদামতো সঞ্চিতি রাখতে না পারায় ১৩টি ব্যাংক শেয়ারধারীদের নগদ লভ্যাংশ দিতে পারেনি। বোনাস লভ্যাংশ দিয়ে শেয়ারধারীদের তুষ্ট করতে হয়েছে এসব ব্যাংককে।

এদিকে গত বছর মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা বদল হওয়া ইসলামী ব্যাংকের মুনাফা কিছুটা বাড়লেও সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের মুনাফা প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ২৯ ব্যাংকের বার্ষিক নিরীক্ষিত প্রতিবেদনের খোঁজ নিয়ে প্রকৃত মুনাফার এসব চিত্র পাওয়া গেছে। গত ৩০ এপ্রিল এসব ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুমোদনের শেষ দিন ছিল। এদিনই কয়েকটি ব্যাংক আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে। তবে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের আর্থিক তথ্য পাওয়া যায়নি।

সূত্র জানায়, ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা থেকে ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণ ও করপোরেট কর দেওয়ার পরই প্রকৃত মুনাফা চূড়ান্ত হয়। তথ্য পাওয়া ২৯ ব্যাংকের মধ্যে ১৩ ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা আগের বছরের চেয়ে কমেছে। বেড়েছে ১৬ ব্যাংকের।

২০১৭ সালে প্রকৃত মুনাফার দিক থেকে শীর্ষে ছিল ব্র্যাক ব্যাংক। ২০১৬ সালে প্রায় ৫৬২ কোটি টাকা মুনাফা করে ন্যাশনাল ব্যাংক শীর্ষে থাকলেও ২০১৭ সালে ৫৫০ কোটি টাকা মুনাফা করে সে স্থান নিয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক। মূলত ভোক্তা ঋণ থেকে ভালো সুদ আয় হয়েছে ব্যাংকটির।

মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা বদল হওয়ার পর ইসলামী ব্যাংক গত বছর ৪৯৩ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। পরিবর্তনে পর আগ্রাসী ঋণ বিতরণ করায় আগের চেয়ে বেশি মুনাফা হয়েছে। তবে চলতি বছরে এসে তারল্যসংকটে পড়ে ঋণ বিতরণ সংকুচিত করে ফেলেছে বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় এ ব্যাংক। আর বিতরণ করা ঋণগুলোর এখনো কিস্তি পরিশোধের সময় আসেনি। ব্যাংকটির প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসতে আরও অপেক্ষা করতে হবে। বর্তমানে চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ব্যাংকটি।

খারাপ অবস্থায় থাকা ন্যাশনাল ব্যাংকের মুনাফা গত বছর কমে হয়েছে ৪৭৯ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি রাখতে না পারায় ব্যাংকটি শেয়ারধারীদের নগদের পরিবর্তে ১২ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে।

দি সিটি ব্যাংকের মুনাফাও ২০১৭ সালে কমে হয়েছে ৩৪৬ কোটি টাকা। এ ব্যাংকের মালিকানায় সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)। মূলত খেলাপি ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি রাখতে গিয়ে মুনাফা কমে গেছে।

জানতে চাইলে সিটি ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে গিয়ে মুনাফা কমে গেছে। আমরা ডিজিটাল সেবায় যুক্ত হচ্ছি। আইএফসি যুক্ত হওয়ায় বিদেশ থেকে কম খরচে তহবিল আসছে। তাই আশা করছি চলতি বছর ব্যবসা ভালো যাবে।’

বেসরকারি খাতের আইএফআইসি ব্যাংকের মুনাফা ২০১৭ সালে এসে আগের বছরের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ আলম সারওয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ব্যাংকের পরিচালনা খরচ কমিয়ে এনেছি। আগের চেয়ে সঞ্চিতিও কম সংরক্ষণ করতে হয়েছে। আবাসন খাতে ঋণ দিয়ে অন্যদের চেয়ে বেশ এগিয়ে গেছি। কারণ, এ ঋণে খেলাপি খুবই কম। এসব কারণে প্রকৃত মুনাফা বেড়েছে।’

মালিকানায় পরিবর্তনের পর সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের মুনাফায় বড় ধস নেমেছে। ২০১৭ সালে ব্যাংকটির শেয়ার কিনে পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনে চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ। এরপর ব্যাংকটির অবস্থা খারাপ হয়েছে। ২০১৬ সালে ২২৯ কোটি টাকা মুনাফা করলেও গত বছরে তা কমে হয় ১৪৬ কোটি টাকা।

একসময় মুনাফায় শীর্ষ পর্যায়ে থাকা প্রাইম ব্যাংকের মুনাফায়ও বড় ধস নেমেছে। ২০১৬ সালে ব্যাংকটি ২১৯ কোটি টাকা মুনাফা করলেও গত বছর তা ১২১ কোটিতে নেমে এসেছে। মূলত বড় ঋণে বিনিয়োগ করেই ব্যাংকটি বিপদে পড়েছে। তাই এখন ছোট ও সিন্ডিকেট ঋণে মনোযোগ দিচ্ছে ব্যাংকটি।

এ ছাড়া সাউথইস্ট ব্যাংকের মুনাফাও অর্ধেক হয়ে গেছে। ২০১৬ সালে ২৪৪ কোটি টাকা মুনাফা করলেও গত বছর তা কমে হয়েছে ১১৬ কোটি টাকা।

আর সংকটে থাকা এবি ব্যাংক ২০১৭ সালে মাত্র ৫ কোটি টাকা প্রকৃত মুনাফা করেছে। ২০১৬ সালে ব্যাংকটি ১৫১ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল। রূপালী ব্যাংক ২০১৬ সালে ১২৮ কোটি লোকসান করলেও গত বছর ৬০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে।

আরও হিসাব
২০১৬ ও ২০১৭ সালে প্রিমিয়ার ব্যাংক যথাক্রমে ১৬০ ও ১৯৭ কোটি, এনসিসি ব্যাংক ২০৮ ও ১৮৪ কোটি, পূবালী ব্যাংক ১৩৯ ও ১৮০ কোটি, ট্রাস্ট ব্যাংক ২০২ ও ১৭৫ কোটি, ঢাকা ব্যাংক ১৫৫ ও ১৬১ কোটি, উত্তরা ব্যাংক ১৫৪ ও ১৫৩ কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ১৪১ ও ১৩৫ কোটি, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ১৬৭ ও ১৩৪ কোটি এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ১০৯ ও ১২৪ কোটি টাকা মুনাফা করেছে।