বিনিয়োগের টাকা নেই

এমনিতে দেশের শিল্প খাতে অর্থায়নের মূল উৎস ব্যাংক খাত একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারিতে বিপর্যস্ত। খেলাপি ঋণ এখন ১ লাখ কোটি টাকা ছুঁই-ছুঁই। আরও ৪৫ হাজার কোটি টাকা হিসাবের খাতা থেকে বাদ বা অবলোপন করা হয়েছে। এতে একদিকে মূলধন ঘাটতি বাড়ছে, অন্যদিকে ব্যাংকগুলো চড়া সুদ আদায় করছে। ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক লাইসেন্স প্রদান, ঋণ আদায় করতে না পারা এবং একের পর এক জোর করে মালিকানা পরিবর্তনে পুরো ব্যাংক খাতই সংকটে পড়ে আছে। এর মধ্যেই ব্যাংকগুলোর আমানত সংগ্রহের চেয়ে ঋণ বিতরণ হয়ে গেছে বেশি।

অর্থায়নের আরেক উৎস পুঁজিবাজার চলে গুজব ও কারসাজির ওপর ভিত্তি করে। বন্ধ ও মুনাফা না দেওয়া কোম্পানির নিম্নমানের শেয়ারের দরই বেশি বাড়ে। আর্থিক প্রতিবেদনের ওপর শেয়ারধারীরা আস্থা রাখতে পারেন না। কিছুদিন পরপরই শেয়ারবাজারের সূচক পড়তে থাকে এবং হস্তক্ষেপ করে সাময়িকভাবে পতন ঠেকাতে হয়।

এ পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা ভবিষ্যতে শিল্পে বাড়তি অর্থায়ন নিশ্চিত করতে দুটি বিকল্প চান। এ জন্য আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে পদক্ষেপ চেয়েছেন। একটি হলো বেসরকারি খাতের জন্য বাজারে বন্ড ছেড়ে প্রকল্পের জন্য সরাসরি ঋণ নেওয়ার সুযোগ সহজ ও আকর্ষণীয় করা। অন্যটি সরকারের লাইসেন্স পাওয়া প্রকল্পগুলোকে পুঁজিবাজার থেকে তহবিল নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। এ ক্ষেত্রে পরপর তিন বছর কোম্পানি মুনাফায় থাকার যে বাধ্যবাধকতা আছে, তা শিথিল করা।

সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০১৯-২০ অর্থবছর নাগাদ দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বিনিয়োগের হার ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। বর্তমানে এ হার ৩১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। যদিও বেসরকারি বিনিয়োগ তেমন একটা বাড়েনি, বেড়েছে সরকারি বিনিয়োগ। কয়েক বছর ধরে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির অনুপাতে ২৩ শতাংশের ঘরে রয়ে গেছে। চলতি বাজারমূল্যে দেশের জিডিপির আকার এখন ২২ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এর অনুপাতে বিনিয়োগ ১ শতাংশ বাড়াতে হলে বাড়তি ২২ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা দরকার। পাশাপাশি নতুন নতুন বড় প্রকল্প আসছে, যেগুলোয় দীর্ঘমেয়াদি বড় অঙ্কের ঋণের চাহিদা তৈরি হচ্ছে।

অবশ্য শুধু অর্থায়ন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একমাত্র সমস্যা নয়। ডুয়িং বিজনেস সূচকে বাংলাদেশে সার্বিক অবস্থান ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৭৭তম। গত বছরও এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এক ধাপ পিছিয়েছে। ব্যবসা শুরু করা, নির্মাণকাজের অনুমতি, জমির নিবন্ধন, গ্যাস-বিদ্যুৎসংযোগ, কর দেওয়া ও চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান তলানির দিকে। বিনিয়োগের জন্য দেশে জমির সমস্যা সমাধানে সরকার অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে। সেগুলো বিনিয়োগ উপযোগী হতে সময় লাগবে। গ্যাস সমস্যা সমাধানের জন্য তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি শুরু হয়েছে। কিন্তু গ্যাসের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। বিদ্যুতের দামও অনেক বেড়েছে। ভবিষ্যতে তা আরও বাড়বে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।

নতুন করে তৈরি হয়েছে উদ্যোক্তা-সংকট। বড় কিছু প্রতিষ্ঠানের বাইরে ছোট প্রতিষ্ঠান বা নতুনদের জন্য বিনিয়োগ করা কঠিন। চলতি বছর নির্বাচন হবে, সেটি নিয়ে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও রয়ে গেছে। সাধারণত অনিশ্চয়তা থাকলে বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত হারে হয় না।

ব্যাংকে টাকার টান
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকগুলোয় যে পরিমাণ আমানত আসছে, তার দ্বিগুণ ঋণ হিসাবে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) ৯৬ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ হয়েছে। একই সময় আমানত বেড়েছে ৪৭ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। এ ঋণের বড় অংশই গেছে বিভিন্ন প্রকল্পে ঠিকাদারদের কাছে। উৎপাদনশীল খাতে ঋণ ততটা বাড়েনি।

ভবিষ্যতে বড় বড় প্রকল্পে বেসরকারি খাতে বাড়তি ঋণচাহিদা তৈরি হবে। ব্যাংকগুলো কি সেই অর্থায়নে প্রস্তুত? জানতে চাইলে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকগুলো সাধারণত পাঁচ থেকে ছয় বছরের জন্য প্রকল্প অর্থায়ন করে থাকে। কেউ কেউ ১০ বছরের জন্যও দেয়। তবে দেশের অর্থনীতি বড় হচ্ছে, ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের মতো বড় কার্যক্রম নেওয়া হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের সুযোগ ব্যাংকের নেই।

বড় প্রকল্পে ঋণের সক্ষমতা নেই
দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে তার পরিশোধিত মূলধনের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দিতে পারে। ফলে অনেক ব্যাংকই একজন গ্রাহককে ৭০০-৮০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ দিতে পারে না। অন্যদিকে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো ঋণ পেতে হিমশিম খাচ্ছে। কারণ একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতেই ৫-৬ বছর চলে যায়। মুনাফা আসে আরও পর থেকে। অথচ বাণিজ্যিক ব্যাংক দুই বছরের গ্রেস পিরিয়ড বা পরিশোধের বিরতি দিয়ে তৃতীয় বছর থেকেই টাকা ফেরত চায়। তবে বড় ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিতে পারে আর্থিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সেখানে সুদের হার অনেক বেশি। এখন তা ১৫-১৮ শতাংশ।

চাপ তৈরি করছে বিদেশি ঋণ
দেশের উদ্যোক্তাদের কাছে এখন আকর্ষণীয় হলো বিদেশি ঋণ। কারণ, বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো দেশি কোম্পানিকে যে সুদহারে ঋণ দেয়, তা দেশীয় উৎসের চেয়ে অনেক কম। গত পাঁচ বছরে বেসরকারি খাতে মোট বিদেশি বাণিজ্যিক ঋণ এসেছে ৭৭৬ কোটি ডলারের। আর ২০১৭ সালেই বিদেশি ঋণ এসেছে ১৪৯ কোটি ডলার।

সাম্প্রতিককালে দেশে আমদানি অনেক বেড়ে গেছে। রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি সে তুলনায় কম। এর মধ্যে আবার বিদেশি ঋণের কিস্তি শোধ বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। এ জন্য বিদেশি ঋণ নিরুৎসাহিত করার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশ্লেষকেরা।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, শিল্পায়নের প্রথম পর্যায়ে বিনিয়োগ ব্যাংকের ঋণের মাধ্যমেই হয়। কিন্তু ভবিষ্যতে এটি একটি বড় বাধা হিসেবে তৈরি হবে। স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ আর কত দিন—এ প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, শিল্পায়িত দেশগুলোয় পুঁজিবাজার অনেক গভীর। উদ্যোক্তারা সেখান থেকেই মূলধন সংগ্রহ করে। আবার বেসরকারি খাত বন্ড থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। সেখানে বন্ড কেনাবেচা হয়। ফলে বিনিয়োগ করলে টাকা আটকে যায় না। বাংলাদেশে বন্ডবাজার গড়ে ওঠেনি। সঞ্চয়পত্রের মতো ঝুঁকিহীন উচ্চ সুদের বিনিয়োগব্যবস্থা থাকলে দীর্ঘ মেয়াদে শিল্পে বিনিয়োগের আর্থিক বাজার গড়ে উঠবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।