শেয়ারবাজারে বাজেট-আতঙ্ক

>
  • আসছে নতুন বাজেট
  • বাজেট ছাড়া বছরটি নির্বাচনেরও
  • নির্বাচনের আগে ঘোষণা করা হচ্ছে বাজেট
  • শেয়ারবাজারের কারসাজিকারীদের জন্য দুটোই বড় হাতিয়ার।
  • সম্প্রতি বাজেটের জুজুর ভয়ে সূচক কমে ৫ হাজারের কাছাকাছি চলে আসে

বাজেটে শেয়ারবাজারের জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো দাবিদাওয়া নেই। তবু বাজেট শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্য এখন বড় ভাবনা। কারণ বাজেটকে কেন্দ্র করে টানা দরপতনে বাজারের সূচক তলানিতে এসে ঠেকেছে। বাজেট ছাড়া বছরটি নির্বাচনেরও। এ কারণে আগেভাগে শেয়ারবাজার ছাড়ছে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও। আর নির্বাচনের বছর হওয়ায় বাজারে কারসাজির প্রবণতা বাড়তে পারে বলে মনে করছেন বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজারে নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকি দুর্বলতা রয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে শুধু বাজেটের জুজুর ভয়ে সূচক কমতে কমতে ৫ হাজারের কাছাকাছি চলে এসেছে। অথচ এ সময়ে আর্থিক খাতে এমন কোনো অবস্থা তৈরি হয়নি, যাতে সূচকের টানা পতন ঘটতে পারে। শেয়ার-বাজারের টানা দরপতন নিয়ে গত কয়েক দিনে কথা হয় বাজারসংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে। তাঁদের কেউই এ দরপতনের যৌক্তিক কোনো কারণ জানাতে পারেননি।

দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাজারের প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন সুশাসনের অভাবকে। তাঁর মতে, একদিকে ভালো কোম্পানির বড় ধরনের দরপতন ঘটছে, আরেক দিকে মানহীন কোম্পানির লাগামহীন দাম বাড়ছে। যৌক্তিক কারণে বাজারে পতন হলে খারাপ কোম্পানিরই বেশি দরপতন হওয়ার কথা। কিন্তু ঘটছে মূলত উল্টোটি। অথচ এসব দেখার যেন কেউ নেই।

সূচকের পতন
ডিএসইর তথ্য বলছে, গত ৫ মাসে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমেছে মোট ৯৩৭ পয়েন্ট। এর মধ্যে টানা পতন শুরু হয় এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে। ২৬ এপ্রিল থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ডিএসইএক্স সূচকটি কমেছে প্রায় ৪৬৭ পয়েন্ট। ফলে গতকাল দিন শেষে সূচক নেমে আসে ৫ হাজার ৩৪৭ পয়েন্টে। চলতি বছরের শুরুর দিনে ডিএসইএক্স ছিল ৬ হাজার ২৫৪ পয়েন্টে।

বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত এক মাসে প্রায় পৌনে ৫০০ পয়েন্ট সূচক কমাতে সবচেয়ে বেশি দরপতন ঘটানো হয়েছে ভালো মানের মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ারের দামের। কারণ সূচকে এসব কোম্পানির শেয়ারের প্রভাব বেশি।

ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, গত ১৪ মে থেকে মাত্র ১৩ কার্যদিবসে গ্রামীণফোনের শেয়ারের দাম ৬০ টাকার বেশি কমেছে। আর এ পতন হয়েছে একটানা। একক কোম্পানি হিসেবে ঢাকার বাজারে সূচকের উত্থান-পতনে বড় ভূমিকা রয়েছে কোম্পানিটির। এ ছাড়া খাত হিসেবে সূচকের উত্থান-পতনে বড় প্রভাব রয়েছে ব্যাংক খাতের। যে কোম্পানির মূলধন যত বেশি সূচকে সেই কোম্পানির প্রভাবও তত বেশি। সাম্প্রতিক দরপতনে সেসব কোম্পানিরই বেশি দরপতন ঘটেছে, যেসব কোম্পানির মূলধন বেশি।
বাজারের সাম্প্রতিক এ দরপতনের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসইর সাবেক পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, সাম্প্রতিক দরপতনে মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ারের দাম যেভাবে কমেছে, তা অযৌক্তিক। এ কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক আরও বেড়েছে।

গুজব আর কারসাজি
গুজবে যাঁরা কান পাতেন, তাঁরা গত এপ্রিল থেকেই শুনছিলেন যে বাজেটের আগে সূচক ৫ হাজারের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। বাজেটের পরে আবার বাড়বে। ঠিক তা-ই হয়েছে। এ সময় ভালো কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারের দর পড়ে যায়। যাঁরা বাজারের কারসাজির ওপর আস্থা রাখেন, তাঁরা এই সুযোগ ঠিকই কাজে লাগাচ্ছেন। বড় বড় কিছু বিনিয়োগকারী আগেভাগে শেয়ার বিক্রি করে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল সূচক কমে একটি পর্যায়ে নামলে কম দামে আবারও শেয়ার কিনে বাজারে সক্রিয় হবেন তাঁরা। এমনকি অনেক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীও তাদের বিনিয়োগ কমিয়ে দিয়েছে বাজারে।

মৌলভিত্তির ৩০ কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস-৩০ তালিকার শীর্ষে রয়েছে এসিআই। গত ১১ কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ৩৯ টাকা কমেছে। গত এক মাসে ২৮ টাকা মূল্য হারিয়েছে ব্লু-চিপস কোম্পানির তালিকাভুক্ত স্কয়ার ফার্মা। অন্যদিকে দুর্বল ও মানহীন কোম্পানি হিসেবে জেড শ্রেণিভুক্ত মর্ডান ডায়িংয়ের শেয়ারের দাম গত ৫ কার্যদিবসেই বেড়েছে ৬২ টাকা। ২৯ মে কোম্পানিটির শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ১৯০ টাকা। গতকাল দিন শেষে তা বেড়ে হয়েছে ২৫২ টাকা। গত ৪ কার্যদিবসে ১৯ টাকা বেড়েছে জেড শ্রেণিভুক্ত নামসর্বস্ব আরেক কোম্পানি রহিমা ফুডের।

এ ছাড়া তালিকাভুক্ত নতুন বেশ কয়েকটি কোম্পানি কয়েক বছর না যেতেই নেমে এসেছে আইপিও মূল্যের নিচে। ২০১৫ সালে বাজারে আসে বস্ত্র খাতের কোম্পানি সিঅ্যান্ডএ। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে কোম্পানিটি প্রতিটি শেয়ার ১০ টাকা অভিহিত মূল্যে বিক্রি করে। গতকাল দিন শেষে এ কোম্পানির শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ৬ টাকা ৪০ পয়সা। একই বছর আইপিওতে ২৬ টাকায় শেয়ার বিক্রি করে বাজারে তালিকাভুক্ত হয় তশরিফা ইন্ডাস্ট্রিজ। গতকাল দিন শেষে সেই দাম কমে নেমে এসেছে ১৮ টাকায়।

দরপতনের কারণ জানতে বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে গত মাসে বৈঠক করেন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সাইফুর রহমান। সেখানে বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পতনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিশ্রেণির বড় বিনিয়োগকারীদের নিষ্ক্রিয়তা, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির চাপসহ বাজেটকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।

মন্দা বিদেশি বিনিয়োগে
বাজেট ইস্যুর পাশাপাশি বছরটি নির্বাচনেরও। এ কারণে বাজারে বিদেশি বিনিয়োগেও কিছুটা মন্দাভাব চলছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনেকে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। ডিএসই সূত্রে প্রাপ্ত সর্বশেষ বিদেশি বিনিয়োগের তথ্য অনুযায়ী, মে মাসে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যে পরিমাণ শেয়ার কিনেছেন, তার দ্বিগুণ বিক্রি করেছেন। এ মাসে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির পরিমাণ ছিল ৬২৪ কোটি টাকার। তার বিপরীতে কেনার পরিমাণ ছিল ৩৪২ কোটি টাকা।

এদিকে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নাম জড়িয়ে আছে। কারণ বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের দুই দফায় কেলেঙ্কারির যে ঘটনা ঘটেছে, দুবারই রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার। তাই নির্বাচনের আগে বাজারের টানা দরপতনে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েছে।

জানতে চাইলে বেসরকারি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের শিক্ষক মোহাম্মদ মুসা বলেন, নির্বাচনের বছরে দেশ থেকে অর্থ পাচার বেড়ে যায়। যে টাকাটা বিদেশে পাচার করা হয়, তা দেশের ভেতরে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করা থাকে। এখন হয়তো শেয়ারবাজার থেকে কেউ কেউ টাকা তুলে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে কারসাজিকারকেরাও বাজারে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। কৌশলে তাঁরা তখন দরপতন ঘটিয়ে কম দামে শেয়ার কিনে নেওয়ার চেষ্টা করেন। পাশাপাশি বাজেটকেও দরপতনের হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে বাজারের সাম্প্রতিক এ দরপতন।

দরপতনের বাজারে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএসইসির মুখপাত্র সাইফুর রহমান বলেন, ‘দরপতন ঠেকাতে আমরা আমাদের নীতি-সহায়তা অব্যাহত রেখেছি। পাশাপাশি নিয়মিত তদারকিও অব্যাহত রয়েছে। বেশ কিছু বিষয়ে তদন্ত চলছে।’