পোশাকের দেশীয় ব্র্যান্ড বাড়ছে

রপ্তানির পাশাপাশি কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগে দেশে পোশাকের নতুন ব্র্যান্ড গড়ে উঠছে। ফাইল ছবি
রপ্তানির পাশাপাশি কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগে দেশে পোশাকের নতুন ব্র্যান্ড গড়ে উঠছে। ফাইল ছবি
>
  • পোশাক রপ্তানিকারকেরা নতুন নতুন ফ্যাশন ব্র্যান্ড করছে
  • পুরোনোরা বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়াচ্ছে
  • দেশের পোশাক বাজার খুবই সম্ভাবনাময়
  • আয় বৃদ্ধির সুবাদে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে
  • বাড়ছে মানসম্মত পোশাকের চাহিদা
  • কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগে নতুন ব্র্যান্ড গড়ে উঠছে

দেশে গত কয়েক বছরে পোশাকের বাজারে বেশ কিছু নতুন ফ্যাশন ব্র্যান্ড চালু হয়েছে। এসব ব্র্যান্ডের অধিকাংশই গড়ে তুলেছে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো, যারা দীর্ঘদিন ধরে এইচঅ্যান্ডএম, ওয়ালমার্ট, জারা, প্রাইমার্ক, গ্যাপ, নাইকিসহ বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন ব্র্যান্ডকে পোশাক সরবরাহ করে আসছে।

কয়েকজন উদ্যোক্তা বলেছেন, দেশের পোশাক বাজার খুবই সম্ভাবনাময়। কারণ আয় বৃদ্ধির সুবাদে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে মানসম্মত পোশাকের চাহিদা। তাই রপ্তানির পাশাপাশি কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগে নতুন ব্র্যান্ড গড়ে উঠছে। স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলো মানসম্মত পণ্য সরবরাহ করায় পোশাক আমদানি কমছে।

গত শতাব্দীর শেষ দিকে ১৯৯৮ সালে পোশাকশিল্পের নামকরা প্রতিষ্ঠান জায়ান্ট গ্রুপের দেশীয় ব্র্যান্ড হিসেবে টেক্সমার্টের যাত্রা শুরু হয়। প্রথম দিকে রপ্তানির পর যেসব পোশাক কারখানায় থেকে যেত, সেগুলোই তারা বিক্রি করত। কয়েক বছর পর অবশ্য নিজস্ব ডিজাইন বা নকশায় পোশাক তৈরি শুরু করে ব্র্যান্ডটি। ২০০৭ সালে শুধু তরুণদের জন্য ওকাল্ড নামে আরেকটি ব্র্যান্ড গঠন করে টেক্সমার্ট।

২০০৪ সালে যাত্রা শুরু হয় বেক্সিমকো গ্রুপের ব্র্যান্ড ইয়েলোর। বর্তমানে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে তাদের ১৯টি বিক্রয়কেন্দ্র আছে। একই বছর চালু হয় ব্যাবিলন গ্রুপের দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘ট্রেন্ডস’।

ব্র্যান্ডের পোশাকের চাহিদা বাড়তে থাকায় ২০১৪ সালে ইভিন্স গ্রুপ ‘নোয়া’ ও অ্যাম্বার গ্রুপ ‘অ্যাম্বার লাইফস্টাইল’ ব্র্যান্ড চালু করে। পরের বছর ইপিলিয়ন গ্রুপ নিয়ে আসে সেইলর। এনার্জিপ্যাক গ্রুপ গত বছর চালু করেছে ‘ও কোড’। এসব গ্রুপ দীর্ঘদিন ধরে তৈরি পোশাক রপ্তানির পাশাপাশি অন্য খাতের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আছে।

পবিত্র ঈদুল ফিতর সামনে রেখে গত কয়েক মাসে তিনটি ফ্যাশন ব্র্যান্ডের যাত্রা শুরু হয়েছে। এর মধ্যে পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান টিম গ্রুপ নিয়ে এসেছে ‘টুয়েলভ’ ব্র্যান্ড, ডেকো গ্রুপ পুরোনো ব্র্যান্ড ম্যানস ক্লাবের দুটি বিক্রয়কেন্দ্র কিনে নিয়ে চালু করেছে ‘ক্লাব হাউস’, আর স্নোটেক্স গ্রুপ মিরপুরে একটি বিক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে চালু করেছে ‘সারা’ নামের ফ্যাশন ব্র্যান্ড।

২০ বছর ধরে পোশাক রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত স্নোটেক্স গ্রুপ। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৩ কোটি মার্কিন ডলার বা ১ হাজার ৯২ কোটি টাকার পোশাক রপ্তানি করেছে গ্রুপটি। তিন মাস আগে তাদের দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড সারার যাত্রা শুরু হয়। এসব তথ্য দিয়ে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এস এম খালেদ গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘তৈরি পোশাক রপ্তানির দীর্ঘ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমরা কম দামে ভালো মানের পোশাক বিক্রির উদ্দেশ্য নিয়ে সারা ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করেছি। ক্রেতাদের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত আমরা দারুণ সাড়া পাচ্ছি। আশা করছি, চলতি বছরের মধ্যে আমরা আরও তিন-চারটি বিক্রয়কেন্দ্র করে ফেলতে পারব।’

এস এম খালেদ বলেন, ‘রপ্তানি বাজারে আমরা অনেক প্রতিযোগিতার মধ্যে ব্যবসা করি। আশা করি, স্থানীয় বাজারেও আমরা ভালো করব।’ তিনি আরও বলেন, দুই দশক পর হয়তো পোশাক রপ্তানির বর্তমান অবস্থা থাকবে না। কিন্তু স্থানীয় বাজারের মাধ্যমে এই ব্যবসা টিকে থাকবে।

ষাটের দশকে রক্সি পেইন্ট দিয়ে ডেকো গ্রুপের ব্যবসায় হাতেখড়ি হয়। পরে পোশাক রপ্তানির ব্যবসায়ে যুক্ত হয়। জারা, ইন্ডিটেক্স, টমি হিলফিগার, টম টেইলর, এস ওলিভারসহ নামীদামি ব্র্যান্ডের পোশাক তৈরি করে তারা। সম্প্রতি ম্যানস ক্লাবের ঢাকার ওয়ারী ও বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্সের দুটি বিক্রয়কেন্দ্র কিনে ফ্যাশন ব্র্যান্ড ক্লাব হাউস চালু করে গ্রুপটি। ইতিমধ্যে তাদের বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে চারটি।

জানতে চাইলে ক্লাব হাউসের ব্র্যান্ড ম্যানেজার মারুফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, দেশের বাজারে মানসম্মত পোশাকের চাহিদা তৈরি হয়েছে। আর যেহেতু মানসম্মত পোশাক তৈরির সুনাম আছে, তাই দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ডের ব্যবসায় নেমেছে ডেকো গ্রুপ। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ক্রেতাদের আন্তর্জাতিক ফ্যাশনের স্বাদ দিতে চাই। পোশাকের দাম অবশ্যই ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখব।’

মারুফুল হক আরও বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে প্রায় সবাই ফ্যাশন-সচেতন। প্রতিনিয়তই ট্রেন্ড পরিবর্তন হচ্ছে। দেশের মানুষের পোশাকের চাহিদা মেটাতে বর্তমানে অনেকগুলো ব্র্যান্ডের দরকার। নতুন নতুন ব্র্যান্ড এলে সুস্থ প্রতিযোগিতাই হবে বলে আমি মনে করি।’

তৈরি পোশাক, ওষুধ, ব্রোকারেজ, বিমা ব্যবসায়ে যুক্ত টিম গ্রুপ। তাদের পাঁচটি পোশাক কারখানা থেকে বছরে ৩৭ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়, যা বাংলাদেশের প্রায় ৩ হাজার ১০৮ কোটি টাকার সমান (প্রতি ডলার ৮৪ টাকা হিসাবে)। ২০১২ সালে উত্তরায় টুয়েলভ নামে দেশীয় পোশাকের ব্র্যান্ড চালু করে গ্রুপটি। চলতি বছর সেই টুয়েলভের নতুন যাত্রা হয়েছে। উত্তরা ছাড়াও ধানমন্ডি, মিরপুর, বনশ্রী ও যমুনা ফিউচার পার্কে বিক্রয়কেন্দ্র আছে তাদের।

জানতে চাইলে টিম গ্রুপের হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ব্র্যান্ডিং মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘২০০৯ সাল থেকে বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের জন্য পোশাক তৈরি করছি আমরা। সেই ডিজাইনকে ফিউশন করে নতুন কিছু করা সম্ভব। তা ছাড়া কোথায় কম দামে ভালো কাপড় পাওয়া যায়, সেটি আমাদের জানা। তাই আমরা মনে করেছি, সাশ্রয়ী মূল্যে দেশের মানুষকে উন্নত মানের পোশাক সরবরাহ করতে পারব। সেই চিন্তা থেকেই টুয়েলভ ব্র্যান্ড করা।’ তিনি আরও জানান, ২০১৯ সালের মধ্যে তাঁদের ২৫টি বিক্রয়কেন্দ্র করার পরিকল্পনা আছে।

১৯৯৪ সাল থেকে পোশাক রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত ইপিলিয়ন গ্রুপ। বছরে তাদের পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ২৫ কোটি ডলার বা ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে যাত্রা শুরু করে তাদের ফ্যাশন ব্র্যান্ড সেইলর। বর্তমানে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ব্র্যান্ডটির বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ১১। সেইলরে প্রায় হাজারখানেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।

জানতে চাইলে ইপিলিয়নের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন আল-মামুন বলেন, ‘ক্রেতাদের কাছ থেকে আমরা ভালো সাড়া পাচ্ছি। গতবারের চেয়ে এবার বিক্রি বেড়েছে ৭০ শতাংশ।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ বাজার খুবই সম্ভাবনাময়। এখানে অনেক ব্র্যান্ড দরকার। তবে বাজারে টিকে থাকতে হলে ক্রেতারা কী চান, সেটি বুঝতে হবে। সে জন্য দুই-তিন বছর লেগে থাকতে হয়।’

রপ্তানিকারকদের হাত ধরে দেশীয় পোশাকের ব্র্যান্ডের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি ফারুক হাসান গত সপ্তাহে প্রথম আলোকে বলেন, দেশে যত মানসম্মত ব্র্যান্ড হবে তত ভালো। এতে করে পোশাক আমদানি কমে যাবে। কেনাকাটার জন্য বিদেশমুখিনতা কমবে। তা ছাড়া দেশে সাফল্য পেলে হয়তো ভবিষ্যতে বাংলাদেশের কোনো ব্র্যান্ড বিদেশেও ব্যবসা করতে যাবে।