উচ্চবিত্তের তুষ্টি, মধ্যবিত্তের কষ্ট

>
  • বাজেটের আকার ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা
  • বাজেটের লক্ষ্য নির্বাচন
  • সংকটের উল্লেখ নেই
  • স্থানীয় শিল্পে সুরক্ষা

রবীন্দ্রনাথের গানে আছে, ‘যাহা-কিছু ছিল সব দিনু শেষ করে/ডালাখানি ভরে-/কাল কী আনিয়া দিব যুগল চরণে/তাই ভাবি মনে’। কালকের কথা পরে, এখন দেখা যাক নির্বাচনের আগে সরকারের শেষ বাজেটে ‘ডালাখানি ভরে’ কাকে কী দিলেন অর্থমন্ত্রী।

গরিব মানুষ আগের চেয়ে কম দামে পাউরুটি খেতে পারবেন, স্যান্ডেলের দামও কমবে। মধ্যবিত্তদের জন্য বরং সংকট বেশি। মূল্যস্ফীতির চাপের মধ্যেও করমুক্ত আয়ের সীমা থাকছে আগের মতোই। আবার ছোট ফ্ল্যাট কেনার পরে নিবন্ধনে খরচ বাড়বে, যাঁরা সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে পোশাকসহ বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি করে কিছু একটা করার চেষ্টা করছিলেন, তাঁদের এখন কর দিতে হবে। গাড়ি নেই, পাঠাও-উবার আছে, ব্যয় বাড়বে এখানেও। আবার দাম বাড়বে পুরোনো গাড়ির।

এবার দেখা যাক, উচ্চবিত্তদের জন্য কী দিলেন অর্থমন্ত্রী। একটু বড় আকারের ফ্ল্যাট নিবন্ধনে খরচ খানিকটা কমবে। তবে সত্যিকার অর্থে অর্থমন্ত্রী ‘ডালাখানি ভরে’ দিয়েছেন কেবল ব্যাংকমালিকদেরই। ব্যাংকের করপোরেট করহার কমানো হয়েছে আড়াই শতাংশ। এর ফলে তাঁদের লাভের পকেট বরং আরেকটু ভারী হবে। এ ছাড়া আয়করেও খানিকটা ছাড় দেওয়া হয়েছে বেশি আয়কারীদের।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গতকাল বৃহস্পতিবার টানা দশমবারের মতো যে বাজেটটি দিলেন, তাতে বিগত ১০ বছরের একটি মূল্যায়ন আছে ঠিকই, কিন্তু ‘কাল কী আনিয়া দিব যুগল চরণে’, তার কোনো বিবরণ পাওয়া গেল না। অর্থমন্ত্রী ১০ বছর ধরেই বাজেট বাড়িয়েছেন। বছর শেষে আয়-ব্যয়ে সংশোধন এনেছেন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটও সেই একই ধারাবাহিকতার। এই বাজেটেরও পুরো বাস্তবায়ন হবে না। কারণ, বাজেট বাস্তবায়নের হার বাড়ানোর কোনো উদ্যোগের কথা অর্থমন্ত্রী এবারও বলেননি। নির্বাচনের আগে সংস্কারেরও কোনো সম্ভাবনা নেই।

সংকটের উল্লেখ নেই
গত এক বছরেই দেশে সবচেয়ে আলোচিত ছিল দুই বিষয়। যেমন সরকারি ব্যাংক খাতের সংকট বেসরকারি খাতে ছড়িয়ে পড়া আর রোহিঙ্গা সংকট। এই দুই অধ্যায় সামান্য ছুঁয়ে গেছেন অর্থমন্ত্রী। এক জায়গায় বলেছেন, ‘দু-একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি সাময়িক উদ্বেগ তৈরি করলেও সময়োপযোগী পদক্ষেপের ফলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে।’ এর পুরস্কার হচ্ছে করপোরেট করহারে মালিকদের ছাড়। এই ছাড় পাওয়ার কারণে আমানতকারীরা সামান্যতম সুবিধা পাবেন না, কমবে না ঋণের সুদহার। অন্যদিকে, রোহিঙ্গা সংকটের কারণে দেশের মানুষের করের টাকার কত অংশ বাড়তি ব্যয় হচ্ছে, তার কোনো হিসাবই দিলেন না অর্থমন্ত্রী। অতিথি খাতে কত ব্যয় তা জানার অধিকারটাই পেলেন না সাধারণ করদাতারা।

১০ বছরের সালতামামি
অর্থমন্ত্রী গত ১০ বছরের অর্জনের একটি তালিকা দিয়েছেন। সেখানে প্রবৃদ্ধির কথা আছে, আছে মাথাপিছু আয় বাড়ার কথা। তিনি বলেছেন, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বৃদ্ধি, বাজেটের বিশাল আকার, রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য কমার কথা। এসবই বড় অর্জন। এই সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশ হয়েছে, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল হওয়ার পথে এগিয়েছে। আবার এখানেই অর্থমন্ত্রী বলেছেন, তাঁর সময়েই সরকারি বিনিয়োগ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ।

কিন্তু দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি বেসরকারি খাত। এই খাতের বিনিয়োগের কোনো খবরের কথা উল্লেখ করলেন না অর্থমন্ত্রী। রবীন্দ্রনাথকে ধার করে বলতে পারি, ‘তোমার বীণায় সব তার বাজে,/ওহে বীণকার,/তারি মাঝে কেন নীরব কেবল/একখানি তার। কারণ, অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই ‘তার’টির অবস্থা ভালো নয়। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বেড়েছে সামান্য। তার প্রমাণ পাওয়া যায় অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতারই আরেক অধ্যায়ে। শিল্প খাতের বিকাশ নিয়ে তিনি বলেছেন, ২০১০ সালে শিল্প খাতে মোট কর্মসংস্থানের অংশ ছিল ২২ দশমিক ৩ শতাংশ, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা নেমে এসেছে ২০ দশমিক ৩ শতাংশে। তাহলে অর্থনীতির প্রকৃত খাতে কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি নিয়ে ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায়’ কত দূর এগোতে পারবে বাংলাদেশ। অর্থমন্ত্রী এবারের বাজেট বক্তৃতার নাম এটাই রেখেছেন।

স্থানীয় শিল্পে সুরক্ষা
নতুন বাজেটে রাজস্ব কার্যক্রম অংশে অর্থমন্ত্রী কিছু স্থানীয় শিল্পকে সংরক্ষণের সুবিধা দিয়েছেন। এর মধ্যে আছে মোটরসাইকেল, সাইকেল, মোবাইল ফোন উৎপাদনসহ আরও কয়েকটি খাত। তবে ছয় মাস পর নির্বাচন বলেই হয়তো এই বিশেষ সংরক্ষণ সুবিধা কত দিন থাকবে, সে কথা জানাননি। এর বাইরে ওষুধসহ বিভিন্ন পণ্যের কাঁচামাল আমদানির ওপর শুল্ক কমানোর কথাও বলেছেন। এতে স্থানীয় শিল্প খাত লাভবান হবে।

বাজেট কাঠামো
নতুন বাজেটের আকার হচ্ছে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট ছিল। বাস্তবায়ন ব্যর্থতায় অর্থমন্ত্রী মাঝপথে সংশোধন করে এই আকার করেন ৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। বাস্তবায়ন অদক্ষতায় আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার শেষ পর্যন্ত চার লাখ কোটি টাকায় দাঁড়াতে পারে।

আগামী বাজেটের মোট টাকার মধ্যে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও ঋণের শোধ দিতেই খরচ হবে ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে বেতন-ভাতা বাবদ খরচ ৬০ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা। আর সুদ পরিশোধে খরচ হবে ৫১ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা। সে হিসাবে এই দুই খাতেই খরচ হবে বাজেটের ২৫ শতাংশ।

বাজেট অধিবেশন
এর আগে জাতীয় সংসদ ভবনের মন্ত্রিসভাকক্ষে মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠকে নির্দিষ্টকরণ বিল, ২০১৮ (সম্পূরক) ও নির্দিষ্টকরণ বিল, ২০১৮ অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য ও প্রতিমন্ত্রীরা উপস্থিত ছিলেন।

পরে জাতীয় সংসদ ভবনে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট প্রস্তাব এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট জাতীয় সংসদে উত্থাপনের সম্মতি দেন।

এরপর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে শুরু হয় সংসদ অধিবেশন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেন এবং অর্থ বিল উত্থাপন করেন।

তাহলে বাজেট কী দেবে
অর্থমন্ত্রীর নতুন বাজেটের পুরো কাঠামোটিই পুরোনো। নির্বাচনের বছর বলেই হয়তো নতুন কোনো পদক্ষেপের দিকে তিনি যেতে চাননি। ফলে এটি শেষ পর্যন্ত একটি গতানুগতিক বাজেট হয়েই থাকছে। তবে অর্থবছরটি গতানুগতিক থাকবে বলেই ধারণা। বিশেষ করে, নির্বাচনের বছরে বেসরকারি বিনিয়োগের স্থবিরতা কাটবে না। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও খারাপের দিকে যাচ্ছে। মনে করা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের চাপ আরও বাড়বে। সুতরাং, অর্থমন্ত্রী বড় বাজেট নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগলেও গতানুগতিকতার বাইরে যেতে না পারার সমালোচনা থেকে হয়তো এবারও রেহাই পাবেন না। কারণ, বিদ্যমান কাঠামোতে এই বাজেটের বাস্তবায়ন হবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে নির্বাচনের বছরে এই বাজেট কতটা স্বস্তি দেবে সাধারণ মানুষকে। বরং বলা যায় নতুন বাজেটে মধ্যবিত্তদের ওপর করের চাপ কিছুটা বাড়বে। সব মিলিয়ে বাজেট উচ্চবিত্তদের তুষ্ট করলেও কষ্ট কমবে না মধ্যবিত্তদের।