বিনিয়োগ বাড়াতে আরও পদক্ষেপ চাই

আবুল কাসেম খান
আবুল কাসেম খান

সংসদে ১২তম বাজেট পেশ করার জন্য অর্থমন্ত্রীকে অভিনন্দন। এবারের বাজেটে মূলত গত বছরের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়েছে। এখানে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বাজেটের ধারাবাহিকতা ও স্থিতিশীলতার স্বার্থেই হয়তো
সরকার সেটা করেছে। কিন্তু আমরা বিষয়টিকে একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করছিলাম। তবে এটাও সত্যি যে আমাদের আশা-প্রত্যাশার জায়গাটা একটু বেশি থাকে। তারপরও বলব, ব্যবসায়ীদের আরেকটু বেশি পাওয়া উচিত ছিল।
আমরা আশা করেছিলাম করপোরেট বা প্রাতিষ্ঠানিক করহারে আরেকটু বেশি ছাড় দেওয়া হবে। কিন্তু শুধু ব্যাংক ও আর্থিক খাতের জন্য করপোরেট করহার আড়াই শতাংশ কমানো হয়েছে। আমাদের আশা ছিল, সব খাতের জন্যই এই কর ছাড় দেওয়া হবে। আমরা হতাশ নই, তবে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাব। কারণ সরকার জিডিপি অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ ২৫ শতাংশের ওপরে নেওয়ার যে লক্ষ্য নিয়েছে, সেটি পূরণ করতে হলে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত লাগবে। এই টাকা তো আসবে মূলত বেসরকারি খাত থেকে। কিন্তু তাদের যদি করের ক্ষেত্রে ছাড় না দেওয়া হয়, তাহলে এ লক্ষ্য পূরণ কঠিন হবে। আমাদের দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এমনিতেই বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। অবকাঠামো, বন্দর, গ্যাস-বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, ব্যবসা পরিচালনার বেশি খরচের মতো অনেক সমস্যা রয়েছে। করপোরেট করহার যদি কিছুটা কমানো হয়, তাহলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়তে পারে। 

অবকাঠামো খাতে বরাদ্দ ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। সরকার বুঝতে পেরেছে অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে দেশের অর্থনীতির একটি সরাসরি সম্পর্ক আছে। এ জন্য বিগত বছরগুলোতে এ খাতে বরাদ্দ তিন গুণ হয়েছে, এটা ভালো দিক। তবে এ বছর রেলওয়েতে বরাদ্দ কম হয়েছে। এ খাতে আরও বেশি বরাদ্দের আশা ছিল। কারণ সড়ক ও জলপথের তুলনায় রেল যোগাযোগব্যবস্থা সবচেয়ে সাশ্রয়ী ও কার্যকর। মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রায় ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখাও ভালো উদ্যোগ। বিশ্বব্যাংকের সহজে ব্যবসা বা ডুয়িং বিজনেস সূচকে উন্নতির জন্য একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে, সেটাও ভালো। তবে সেখানে বেসরকারি খাতকে যাতে রাখা হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা বিষয়গুলো ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরতে পারবেন।
দেশে মোটরসাইকেলশিল্পের প্রসারের জন্য মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্তটি ইতিবাচক। একইভাবে মোবাইল ফোন, সাইকেল সংযোজন ও উৎপাদনেও একটা প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে স্থানীয় শিল্পের প্রসারের জন্য যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এটা বেশ ইতিবাচক। এতে কর্মসংস্থান বাড়বে ও সংযোগ শিল্পের প্রসার ঘটবে। তবে আসবাবশিল্পে ভ্যাটের হার বাড়ানো ঠিক হয়নি। কারণ এই খাতটি বাংলাদেশের জন্য একটা বড় সম্ভাবনাময় খাত।
করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়ের একটি অংশ গবেষণায় ব্যবহার করা হলে ওই আয়ের ওপর আমরা কর অব্যাহতি চেয়েছিলাম, সেটাও পাইনি। আমাদের আশা ছিল, ন্যূনতম একটা কর ছাড় পেলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্য উন্নয়নে গবেষণায় টাকা খরচ করত। যেহেতু এখানে বিনিয়োগ করে কর ছাড় মিলছে না, তাই গবেষণায় নতুন বিনিয়োগও হচ্ছে না। অবশ্য লভ্যাংশ আয়ের ওপরে দ্বৈত কর রহিত করা হয়েছে, এটাকে আমরা ভালো দিক হিসেবে দেখছি। পাট খাতের উন্নয়নে নেওয়া পদক্ষেপগুলোও ভালো।
শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। এটা আরও বাড়ানো উচিত। যেসব পরিবার সন্তানদের পড়ালেখার জন্য অর্থ খরচ করে, তাদের আয়ের ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত কর অব্যাহতি দেওয়া যেতে পারে। কোনো পরিবার যদি তাদের সন্তানদের পড়ালেখার জন্য অর্থ খরচ করে, তাহলে সরকারের উচিত তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসা। এমন ছাড় পেলে পরিবারগুলোও শিক্ষার পেছনে অর্থ খরচে উৎসাহী হবে। ব্যক্তিপর্যায়ের করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর বিষয়ে কোনো উদ্যোগ বাজেটে আমরা দেখলাম না।
রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার বিবেচনায় বাজেট উচ্চাভিলাষী। কারণ এ ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে। কিন্তু দেশের অর্থনীতির আকার অনুযায়ী সামগ্রিকভাবে বাজেট ততটা উচ্চাভিলাষী নয়। দেশের সামগ্রিক জিডিপির অনুপাতে বাজেটের আকার ১৮ শতাংশ, এটা ২৫ থেকে ২৮ শতাংশ হতে পারে। রাজস্ব আদায় বাড়াতে হলে কর আহরণের পরিধি বাড়াতে হবে। আর্থিক খাতের সংস্কারে কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা বাজেটে নেই। যেকোনো ঋণ বিতরণ ও সংগ্রহের বিষয়ে নিয়মকানুন মানায় কঠোর হতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না।
বাজেটকে কেন্দ্র করে চিন্তা করা হলে বাংলাদেশে বিনিয়োগের মূল সমস্যা হলো করনীতি। বাজেটে বিনিয়োগবান্ধব পদক্ষেপ আরও বেশি দরকার ছিল। বর্তমান করনীতি ততটা বিনিয়োগবান্ধব নয়। একদিকে বলা হচ্ছে বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা, অন্যদিকে কর বাড়িয়ে বিনিয়োগের বাড়তি অর্থ সরকার নিয়ে যাচ্ছে। করহারে ছাড় দিলে যে অর্থ সাশ্রয় হয়, সেটা যাতে বিনিয়োগ করা হয়, সেটি সরকার নিশ্চিত করতে পারে। সরকার একটি কাজ করতে পারে, যন্ত্রপাতি স্থাপন বা উৎপাদন সহায়ক কাজে বিনিয়োগ করলে ওই অর্থের ওপর কর ছাড় দিতে পারে।