অব্যবস্থাপনার পুরস্কার করছাড়

এমসিসিআই ও পিআরআই আয়োজিত বাজেট আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দিচ্ছেন (ডান থেকে দ্বিতীয়) এনবিআরের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। গতকাল রাজধানীর মতিঝিলের মেট্রো চেম্বার ভবনে।  ছবি: প্রথম আলো
এমসিসিআই ও পিআরআই আয়োজিত বাজেট আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দিচ্ছেন (ডান থেকে দ্বিতীয়) এনবিআরের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। গতকাল রাজধানীর মতিঝিলের মেট্রো চেম্বার ভবনে। ছবি: প্রথম আলো
>

• এমসিসিআইয়ের আলোচনা
• ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর বিষয়টি পুনর্বিবেচনার দাবি করেন ব্যবসায়ী নেতারা

ঋণের সুদের হার কমানোর শর্ত দিয়েই ব্যাংকের করপোরেট কর কমানো উচিত বলে মনে করছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তাঁর মতে, এবার শুধু আর্থিক খাতেই করপোরেট কর কমানো হয়েছে। অথচ এই খাতে সুশাসনের অভাব আছে। এই খাতের অব্যবস্থাপনাকে করছাড় দিয়ে পুরস্কৃত করা হচ্ছে। তাঁর সুপারিশ হলো, ব্যাংকের ঋণের গড় সুদের হার যদি ১০ শতাংশের নিচে নামানো হয়, তবেই করপোরেট করহার কমানো উচিত।

গতকাল বৃহস্পতিবার মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ও পিআরআই আয়োজিত বাজেট আলোচনার মূল প্রবন্ধে আহসান এইচ মনসুর এই কথা বলেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া তাঁর বক্তব্যে এ প্রসঙ্গে বলেন, করপোরেট কর কমার সুবিধা ব্যাংক খাত সৌভাগ্যবশত পেয়ে গেছে। অর্থমন্ত্রীর ইচ্ছা ছিল, এবার করপোরেট কর কমানো হবে। কিন্তু ঢালাওভাবে করপোরেট কর কমালে অনেক রাজস্ব ক্ষতি হয়। মোবাইল ফোন অপারেটর ও তামাক খাতের কোম্পানিগুলো ছাড়া ব্যাংকের করপোরেট করহার সবচেয়ে বেশি। তাই ব্যাংকের করপোরেট করহার কমানো হয়েছে।

এনবিআর চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘ব্যাংকের করপোরেট কর কমানোর পেছনে আরেকটি কারণ ছিল, সুদের হার কমানোর জন্য চাপ দিতে পারব। যদিও সরাসরি তা দেওয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত (আলটিমেটলি) সুদের হার কমানোর কথা বলা হবে।’

রাজধানীর মতিঝিলের মেট্রো চেম্বার ভবনে এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন এমসিসিআই সভাপতি নিহাদ কবির। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনে আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে ছিলেন নিরীক্ষা ও করসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান কেপিএমজির জ্যেষ্ঠ অংশীদার আদিব এইচ খান। অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ী ও গবেষকেরা বক্তব্য দেন।

আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানের করপোরেট করহার আড়াই শতাংশ কমানোর ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

এদিকে গত বুধবার ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)। আগামী ১ জুলাই থেকে এই সুদহার কার্যকর হবে। এ প্রসঙ্গে অনুষ্ঠানে আহসান এইচ মনসুর বলেন, এভাবে সুদের হার কমানোর ঘোষণা দেওয়া বেআইনি। কেননা কোনো বেসরকারি পর্যায়ের সংগঠন তাঁর সদস্যদের এভাবে সুদের হার কমানোর নির্দেশ দিতে পারে না। এটি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়। সুদের হার বাজারভিত্তিক হতে হবে। তবে সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা সুদের হার নিয়ে কিছু নির্দেশনা দিতে পারে।

অন্যদিকে এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া অনুষ্ঠানে বাজেটের পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে তুলে ধরেন। নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীর আয়কর বিবরণীর তথ্য এনবিআরকে জানানো প্রসঙ্গে বলেন, তৈরি পোশাক খাত ছাড়া অন্য সব খাতের সিংহভাগ কর্মী ১৬ হাজার টাকার বেশি বেতন পান। ১৬ হাজার টাকার বেশি বেতন পেলে রিটার্ন দেওয়া বাধ্যতামূলক। সরকারি কর্মকর্তারা রিটার্ন জমা দেন। তাহলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা কেন দেবেন না?

করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি না করার যুক্তি দেখিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘উন্নত দেশগুলোতে মাথাপিছু আয়ে ২০ শতাংশকে করমুক্ত আয়সীমা হিসেবে ধরা হয়। আর আমাদের মতো দেশে ১০০ থেকে ১২০ শতাংশ পর্যন্ত এই সীমা থাকে। বাংলাদেশে করমুক্ত আয়সীমা মাথাপিছু আয়ের প্রায় ১৯০ শতাংশ। এ ছাড়া এ দেশের তরুণদের মধ্যে কর দেওয়ায় বেশ উৎসাহ আছে। যদি করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি করা হয়, তবে বিপুলসংখ্যক তরুণ করজাল থেকে বেরিয়ে যাবে। আমরা কর প্রদানের অভ্যাস বাদ দিতে চাই না।’

কাঙ্ক্ষিত হারে বেসরকারি বিনিয়োগ না হওয়ায় ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করেন আহসান এইচ মনসুর। তাঁর মতে, এমনিতেই বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা আছে।

নির্বাচনের বছরে এই পরিস্থিতির উন্নতিও হবে না। তাই ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন চ্যালেঞ্জিং হবে। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের বছর হওয়ায় রাজস্ব খাতে কোনো সংস্কার হয়নি। তাই আগামী অর্থবছরের যে রাজস্ব লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে, তা অর্জিত হবে না। এমন অবস্থায় নির্বাচনের পরপরই ভ্যাট আইন বাস্তবায়নসহ অন্যান্য সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেওয়া উচিত হবে।

আলোচনায় অংশ নিয়ে শিল্পগোষ্ঠী এসিআইয়ের চেয়ারম্যান আনিস উদ দৌলা বলেন, সুপারশপে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এটি মধ্যবিত্তের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।

এমসিসিআই সভাপতি নিহাদ কবির বলেন, রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনার জন্য তৈরি পোশাক খাতের পাশাপাশি অন্য খাতকে করসুবিধা দেওয়া উচিত।

আদিব এইচ খান তাঁর মূল প্রবন্ধে এবারের বাজেটের অর্থবিলের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তিনি ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনার করার সুপারিশ করেন।

সাবেক বাণিজ্যসচিব সোহেল আহমেদ চৌধুরী বলেন, প্রকল্পের ব্যয় বাড়লে খরচ বাড়ে, আবার গুণগত মানের কাজও হয় না। এসব বিষয়ে নজরদারি বাড়ানো উচিত।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন পিআরআইয়ের চেয়ারম্যান জাঈদী সাত্তার, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের পরিচালক আবদুল খালেক, মাল্টিমোড গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক আবদুস সালাম, এমসিসিআইয়ের করসংক্রান্ত উপকমিটির সদস্য সাঈদ আহমেদ খান প্রমুখ।