বড় স্বপ্ন দেখার সঙ্গে শিক্ষায় বেশি গুরুত্ব দিতে হবে

>লীনা নায়ার ইউনিলিভারের প্রথম নারী, প্রথম এশীয় ও কনিষ্ঠতম কর্মী হিসেবে প্রধান মানবসম্পদ কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি ঢাকা সফরের সময় তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে করপোরেট জগতে নারী নেতৃত্ব নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আয়েশা কবির
লীনা নায়ার
লীনা নায়ার

প্রথম আলো: আপনি তো ইউনিলিভারের প্রথম নারী সিএইচআরও (চিফ হিউম্যান রিসোর্স অফিসার—প্রধান মানবসম্পদ কর্মকর্তা)। পশ্চিমের পরিপ্রেক্ষিতেও এটি এক বড় অর্জন, কারণ নারীদের পক্ষে করপোরেট জগতে শীর্ষে যাওয়া কঠিন ব্যাপার। সেখানে যাওয়ার পথটা আপনার জন্য কেমন ছিল? বাংলাদেশের যে নারীরা সেই স্বপ্ন দেখে, তাঁদের জন্য আপনার কী উপদেশ?

লীনা নায়ার: বড় স্বপ্ন দেখতে হবে, উচ্চাভিলাষী হতে হবে। এশিয়ার সামাজিক পরিবেশটা বড় স্বপ্ন দেখার অনুকূল নয়। তাই আমি সব জায়গার নারী ও পুরুষকে বড় স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করব।

দ্বিতীয়ত, ব্যাপারটা হলো বড় কাজ করার জন্য আত্মবিশ্বাস ও সাহস থাকতে হবে। ক্যারিয়ারের শুরুতে আমার প্রথম তিনটি দায়িত্ব ছিল তিনটি ভিন্ন কারখানায়। একটি কারখানায় আমি উৎপাদন ব্যবস্থাপক ছিলাম। আরেক কারখানায় ছিলাম মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক। এমনকি আমাকে বিক্রয়ের কাজও করতে হয়েছে। ব্যাপারটা কঠিন ছিল। তৃণমূলে গিয়েই আপনাকে কাজটা শিখতে হবে। নারী হয়েও আমি এক কারখানার রাতের পালায় কাজ করতে গেলে সবাই বলল, এর আগে আর কোনো মেয়ে রাতের পালায় কাজ করেনি। তো এ রকম ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত হওয়া যাবে না, বরং প্রশ্ন করতে হবে, ‘আমি যদি প্রথম সেই নারী হই, তাহলে সমস্যা কী? আমাকে রীতিটা তৈরি করতে করতে দিন’।

এই কথাটা শেষ বলছি বলে তা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, সেটা হলো, পরামর্শদাতা খোঁজা বা যোগাযোগের গুরুত্ব আছে। সফল নারী ও পুরুষের কাছে যেতে হবে। ক্যারিয়ারের জন্য তাঁদের উপদেশ চাইতে হবে।

ভারতের ছোট্ট এক শহর কোলহাপুরে আমার জন্ম। সেটা এমন এক জায়গা, যেখানে মেয়েদের স্কুল পর্যন্ত ছিল না। তো শহরে মেয়েদের প্রথম স্কুল যখন হলো, তখন আমি প্রথম ব্যাচে ভর্তি হই। মেয়েদের সচরাচর যেসব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়, আমাকেও সেই সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। আমার মা বলতেন, ‘তুমি এত পড়াশোনা করছ কেন? তোমাকে কে বিয়ে করবে?’ পরিবারের সঙ্গে আমি শুধু শিক্ষা নিয়ে লড়াই করেছি। তাই প্রথমত শিক্ষাতেই নজর দেওয়া উচিত।

আমরা অগ্রগামী মানুষ, তাই অন্যরা জিজ্ঞাসা করবে, ‘আপনি কাজ করছেন কেন? আপনার স্বামীর কি চাকরি নেই? আপনি তো নারী, কারখানায় কাজ করছেন কেন?’ ইত্যাদি প্রশ্ন নারীদের দিকে ধেয়ে আসবে। তাই এসব নিয়ে বেশি মাথা ঘামানো যাবে না। আপনি সফল হলে সবাই আপনাকে নিয়ে আহ্লাদ করবে। আমার মা এখন আমাকে নিয়ে খুবই গর্বিত, তিনি আমার কথা রাষ্ট্র না করে থাকতে পারেন না।

প্রথম আলো: ইউনিলিভারে কি লৈঙ্গিক সংবেদনশীলতা আছে? নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যাপারে তার অবস্থান কী?

লীনা নায়ার: বৈশ্বিক পরিসরে ইউনিলিভারে ৪৬ শতাংশ নারী কাজ করছেন। আমাদের লক্ষ্য হলো তা ৫০ শতাংশে উন্নীত করা। সংখ্যার প্রসঙ্গে বলতে হয়, নিয়োগের সময় তালিকায় দুজন মেধাবী পুরুষ থাকলে দুজন মেধাবী নারীও থাকতে হবে। সংস্কৃতির ব্যাপারে বলা দরকার, আমাদের ‘আন-স্টেরিওটাইপ’ শীর্ষক এক উদ্যোগ আছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা কর্মীদের প্রতিষ্ঠানের পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে অবহিত করি। এর সঙ্গে আমরা যেসব ধারণা করি এবং মানুষকে কীভাবে গর্তের মধ্যে ফেলি, সেসব ব্যাপারেও তাঁদের শিক্ষিত করি। মানুষ যেন গৎবাঁধা হয়ে না যায়, সে জন্য আমরা কঠোর পরিশ্রম করি।

নেতৃত্বগুণ বিকশিত করে, পরামর্শ দিয়ে ও রোল মডেল তৈরি করে নারীদের সহযোগিতা করতে হবে। পরিবর্তনে পুরুষেরাও কীভাবে অনুঘটক হতে পারে, সেটা তাঁদের বোঝাতে হবে। এখন পুরুষেরা যেহেতু প্রভাবশালী পদে আছেন, তাই তাঁদের নেতৃত্ব দিতে হবে। কোম্পানির পুরুষ কর্তাদের বোঝাতে হবে, অন্তর্ভুক্তি ও বৈচিত্র্য ব্যবসায় কীভাবে কাজে আসে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানকেও নমনীয় হতে হবে।

প্রথম আলো: যোগ্য নারী খুঁজে পাওয়া কি কঠিন? সাধারণভাবে এমন ধারণা আছে যে নারীদের পক্ষে ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনের মধ্যে সমন্বয় করা কঠিন।

লীনা নায়ার: বিপুলসংখ্যক যোগ্য ও মেধাবী নারী আছেন, তাঁদের খুঁজে বের করতে হবে। কর্মজীবী মা ও বাবাদের ব্যাপারে ইউনিলিভার বাস্তবসম্মত, তাঁদের ব্যাপারে আমরা নমনীয়। মাতৃত্বকালীন ছুটি কাটিয়ে ফিরে আসা মায়েদের জন্য বাঁধাধরা কর্মসময় নেই। আমাদের প্রতিষ্ঠানে কাজ ভাগাভাগি করে নেওয়ার সুযোগ আছে। আর আওতায় দুজন ব্যক্তি একটি কাজ ভাগ করে নিতে পারেন। অর্থাৎ সপ্তাহের অর্ধেক সময় একজন করেন, বাকি অর্ধেক সময় আরেকজন করেন। নারীদের সহায়তা করার লক্ষ্যেই এসব সুযোগ রাখা হয়েছে। তাঁদের কাজে ফিরে আসতে উৎসাহিত করা এবং ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনের মধ্যে ভারসাম্য আনার সুযোগ দিতেই এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরুষদের জন্যও পিতৃত্বজনিত সুবিধাসহ আরও কিছু উদ্ভাবনী ব্যবস্থা আছে।

প্রথম আলো: বৈশ্বিক চাহিদা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সঙ্গে ইউনিলিভার কীভাবে খাপ খাইয়ে নেয়? পরিবর্তনের গতির সঙ্গে তাল মেলানোর মতো যোগ্য ও দক্ষ মানুষ কি আপনারা খুঁজে পান?

লীনা নায়ার: ইউনিলিভারের প্রাতিষ্ঠানিক নীতিগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কর্মীদের নতুন কাজে দক্ষ করে তোলা, যাকে বলে রি-স্কিলিং। এই খাতে আমাদের বিপুল বিনিয়োগ আছে। আমাদের দুটি সুনির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট আছে; একটি লন্ডনে, আরেকটি সিঙ্গাপুরে। প্রতিদিনই আমরা কর্মীদের নেতৃত্বগুণ বিকশিত করার চেষ্টা করছি। প্রযুক্তিসংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকল্পে আমরা বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছি। শিক্ষণের জন্য আমাদের হাতে ৯০ হাজার ঘণ্টার উপাদান আছে। কর্মীরা যাতে ব্যস্ত সময়ের মধ্যেও তা ব্যবহার করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করাই আমাদের চ্যালেঞ্জ। ইউনিলিভার বাংলাদেশে‘১০ মিনিটের স্কুল’ শীর্ষক একটি শিক্ষণমূলক উপাদান আছে। এর মাধ্যমে ১০ মিনিটের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কোনো ধারণা ব্যাখ্যা করা হয়: কীভাবে আরও ভালোভাবে বিক্রি করা যায়, কীভাবে আরও ভালোভাবে আলোচনা করা যায় প্রভৃতি। এটি এখানে ঠিকঠাক কাজে দিলে তা আমি অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে চাই।

প্রতিটি শিল্পেই কাজের ধরন বদলে যাবে এবং মানুষকে সেই কাজ করতে গেলে নতুন করে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। ইউরোপীয় দেশগুলোতে ই-কমার্স, অনলাইন বিক্রয় ও বিপণনের পরিসর বড় হয়ে উঠছে। ভারত ও বাংলাদেশেও আমাদের একইভাবে পরিকল্পনা করতে হবে। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, সম্মুখ সারির বিক্রয়কর্মীদের ইন্টারনেটে বিক্রি করা শেখাতে হবে। সোজা কথা, পরিবর্তনের ধারাগুলো খেয়াল করতে হবে এবং সে অনুযায়ী মানুষকে দক্ষ করে তুলতে হবে।

শিক্ষাব্যবস্থা যাতে বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে, সে জন্য সরকারের সঙ্গে আমাদের কাজ করতে হবে। প্রথমত, পাঠ্যসূচি সময়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক থাকতে হবে; দ্বিতীয়ত, বয়স্কদের শিক্ষণে নজর দিতে হবে, যাতে তাঁরা নতুন দক্ষতা অর্জন করতে পারে। সরকারি ও বেসরকারি খাতের কোম্পানিগুলোকে কর্মীদের নতুন দক্ষতা শেখানোর কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। অর্থাৎ কোন ধরনের কাজের দক্ষতা প্রয়োজন হবে, সে অনুযায়ী মানুষকে নতুন দক্ষতা শেখাতে হবে; যেমন ই-কমার্স।

প্রথম আলো: সাধারণভাবে ধারণা আছে যে বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো নির্মম ও অমানবিক কায়দায় মুনাফা অর্জন করে। কিন্তু ইদানীং তাদের মানবিক রূপ দেখা যাচ্ছে। ইউনিলিভারের প্রসঙ্গে কী বলবেন?

লীনা নায়ার: করপোরেটগুলোকে আরও মানবিক হতে হবে। ইউনিলিভার সব সময়ই মানবিক থাকার বিশেষাধিকার পেয়ে এসেছে। এমনকি তার শতাধিক বছরের পুরোনো কারখানাগুলোর নিরাপত্তাব্যবস্থা অত্যন্ত উচ্চ মানের। আর ব্যবসায় আমরা সব সময়ই ভালো করি। বাংলাদেশ বা যেখানেই হোক, ইউনিলিভার সবখানেই ভালোর পক্ষের শক্তি। আমাদের বরাবরই মানবিক একটি রূপ ছিল। এটাই আমাদের ঐতিহ্য, ডিএনএ। দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে কোনো কোম্পানিকে অধিকতর সফল হতে হলে তাকে আরও মানবিক হতে হবে।

প্রথম আলো: বাংলাদেশে ইউনিলিভারের কার্যক্রমে আপনি কি সন্তুষ্ট?

লীনা নায়ার: নিশ্চিতভাবেই গত ছয় বছরে বাংলাদেশে নিয়োগদাতা হিসেবে ইউনিলিভারের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত প্রতিষ্ঠান, তা জেনে আমি গর্বিত। বাংলাদেশের মেধাবী মানুষদের দেখে আমার আনন্দ হয়। বাংলাদেশ সব সময়ই আমাকে উৎসাহিত করে।