অবশেষে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়ে গেল বাণিজ্যযুদ্ধ

যুক্তরাষ্ট্র গতকাল ৩৪ বিলিয়ন ডলারের চীনা পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর চীনও পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে। চীন বলছে, ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এই শুল্কযুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্রই দায়ী। সম্প্রতি চীনের সাংহাইয়ের ইয়াংশ্যাম বন্দরে।  ছবি: রয়টার্স
যুক্তরাষ্ট্র গতকাল ৩৪ বিলিয়ন ডলারের চীনা পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর চীনও পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে। চীন বলছে, ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এই শুল্কযুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্রই দায়ী। সম্প্রতি চীনের সাংহাইয়ের ইয়াংশ্যাম বন্দরে। ছবি: রয়টার্স
>
  • ঢাকঢাক গুড়গুড় করার পর দুই দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরুর ঘোষণা দিল।
  • এতে শেষ বিচারে কারও লাভ হবে না।
  • চীনের সঙ্গে ৩৭৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে যুক্তরাষ্ট্র অতিরিক্ত আমদানি শুল্ক আরোপের প্রস্তুতি নিচ্ছে

এ যেন একধরনের খেলা, রেফারি হুইসেল বাজাতেই মাঠে বল নিয়ে নেমে পড়ল দুই দল। শুক্রবার মধ্যরাতের পর ঘড়ির কাঁটা যখন ১২: ০১, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পরস্পরের ওপর আমদানি শুল্ক আরোপের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে এক বাণিজ্যযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরুর ঘোষণা দিল। মোট ৩৪ বিলিয়ন ডলারের শুল্ক আরোপের প্রথম পদক্ষেপ নেয় যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন একই পরিমাণ শুল্ক আরোপ করে ঠিক তার পরপরই।
ট্রাম্প প্রশাসন জানিয়েছে, চীনের সঙ্গে ৩৭৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে তারা আরও অতিরিক্ত আমদানি শুল্ক আরোপের প্রস্তুতি নিচ্ছে। খেলার দ্বিতীয় রাউন্ডে মোট শুল্কের পরিমাণ ৫০০ বিলিয়ন ডলার বা তার চেয়েও বেশি হতে পারে।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্র যে একে অপরের বিরুদ্ধে ঢিল বনাম পাটকেল ছোড়ায় লিপ্ত হবে, এটি কোনো অজ্ঞাত ব্যাপার ছিল না। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় চীন যে ভাষায় যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেছে, তাতে অনেকেই পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের আভাস দেখতে পেয়েছেন। চীনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় শুল্ক আরোপের যে ঘোষণাটি প্রকাশ করে, তাতে এই সিদ্ধান্তকে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ নামেই অভিহিত করা হয়। ওই ঘোষণায় বলা হয়, ‘অর্থনৈতিক ইতিহাসের সর্ববৃহৎ বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হলো।’ তারা দাবি করে, নিজেদের মৌলিক স্বার্থ রক্ষার জন্যই তাদের বাধ্য হয়ে এই পাল্টা ব্যবস্থা নিতে হলো। এর সব দায়দায়িত্ব আমেরিকার ওপর চাপিয়ে চীন জানায়, আমেরিকার গৃহীত ব্যবস্থার একমাত্র লক্ষ্য চীনকে ভয় দেখিয়ে নতজানু হতে বাধ্য করা। কিন্তু চীন মাথা নোয়াবে না। যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার প্রতিষ্ঠিত নিয়মের পরিপন্থী—এই প্রশ্নে তারা ডব্লিউটিওতে মামলা করবে বলে চীনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায়।
সরকারনিয়ন্ত্রিত পিপলস ডেইলি পত্রিকার ইংরেজি সংস্করণে বাণিজ্যযুদ্ধের বিষয়টি আরও খোলাসা করে বলা হয়। পত্রিকাটির ভাষায়, আমেরিকা এক চীনের বিরুদ্ধে নয়, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যুদ্ধ শুরুর হুমকি দিয়েছে। ‘যখন দুজন মানুষ লড়াই করে, তখন তারা উভয়েই লড়াই শুরুর জন্য দায়ী বলে ভাবা যায়। কিন্তু কেউ যখন অন্য সবার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামে, তখন তো স্পষ্ট, দোষটা কার।’
চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরুর আশঙ্কায় এশিয়ার শেয়ারবাজারসমূহ কয়েক দিন ধরেই নিম্নমুখী। এই ঘোষণার সময় নিউইয়র্কের প্রধান শেয়ারবাজারসমূহ বন্ধ ছিল, ফলে তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি। মার্কিন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর আশু প্রতিক্রিয়া নেতিবাচক হতে বাধ্য।
নির্বাচনী প্রচারণার সময় থেকেই ট্রাম্প চীনের বিরুদ্ধে অসম বাণিজ্যের অভিযোগ করে আসছেন। এই দেশের সঙ্গে বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে তিনি বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করতে প্রস্তুত, এ কথাও বলেছেন। ‘বাণিজ্যযুদ্ধে জেতা খুব সহজ’, তিনি এ কথা একাধিকবার বলেছেন।
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, পুরো মাত্রায় বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হলে তাতে কোনো এক পক্ষের জেতার সম্ভাবনা কম। চীনে মার্কিন চেম্বার অব কমার্সের প্রধান উইলিয়াম জারিট এক বিবৃতিতে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অব্যাহত উত্তেজনা মার্কিন কোম্পানিসমূহের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। ‘এই যুদ্ধে কেউ জিতবে না’, তিনি জানান।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবশ্য ধরে নিয়েছেন, এর ফলে রাজনৈতিকভাবে তিনি লাভবান হবেন। তাঁর বিশ্বাস, চীন যে অসম বাণিজ্যনীতি অনুসরণ করে থাকে, এই যুক্তি মার্কিন ভোটারদের তিনি বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। আমদানি শুল্ক আরোপের ফলে কোনো কোনো পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলেও দীর্ঘমেয়াদি হিসেবে মার্কিন অর্থনীতি লাভবান হবে বলে ট্রাম্পের পরামর্শদাতারা জানিয়েছেন।
বাণিজ্যযুদ্ধের এই পর্যায়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে রয়েছে মার্কিন খামারমালিকেরা। চীন যে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে, তার লক্ষ্যই হলো সয়াবিন, শূকরের মাংস ও অন্যান্য কৃষিজাত পণ্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই যুদ্ধ যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে আমেরিকার অনেক কৃষি খামার বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এনবিসি নিউজ এক বিশ্লেষণে জানিয়েছে, গত নির্বাচনে কৃষি খাতের মালিক-কর্মচারীরা বিপুল সংখ্যায় ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের অনেকেই এখন নিজের হাত কামড়ানো শুরু করেছেন।
একজন খামারমালিক এনবিসিকে জানিয়েছেন, কৃষিখামারগুলোকে বাঁচাতে ব্যাংক থেকে অনায়াসে ঋণ মিলবে—এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই। কোনো কোনো খামারমালিককে এক বছরের মধ্যেই ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হতে পারে।
শুধু চীন নয়, কৃষিপণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপের ব্যবস্থা নিয়েছে মেক্সিকো, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যরা। তাদের বিশ্বাস, ট্রাম্পকে আঘাত করার সবচেয়ে কার্যকর পথ হলো ট্রাম্পের সবচেয়ে কট্টর সমর্থকদের আঘাত করা। লোহা ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানির ওপর ট্রাম্পের ঘোষিত শুল্কের জবাবে এই দেশগুলো মুখ্যত কৃষিজাত পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে।