ক্রেতারা অ্যাপার্টমেন্ট কেনায় আগ্রহী হচ্ছেন

>
ড. তৌফিক এম সেরাজ
ড. তৌফিক এম সেরাজ
ড. তৌফিক এম সেরাজ প্রকৌশলী ও পরিকল্পনাবিদ। বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠান শেলটেক (প্রা.) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনি। বুয়েটের সাবেক এই শিক্ষক কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন। আবাসন ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) তিন মেয়াদে সভাপতি ছিলেন। আবাসন ব্যবসার নানা প্রবণতা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর পার্থ শঙ্কর সাহার সঙ্গে।

প্রথম আলো: নতুন বছর। নির্বাচনের পর আবার ক্ষমতায় আগের সরকার। নির্বাচনের আগে আপনারা একটা অনিশ্চয়তার কথা বলেছিলেন। এখন পরিস্থিতি কেমন?

তৌফিক এম সেরাজ: নতুন বছরের শুরু থেকেই দেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বেশ ভালো। এ অবস্থায় ক্রেতারা অ্যাপার্টমেন্ট কেনার ব্যাপারে এখন আগ্রহী হচ্ছেন। তাই আমরা ২০১৯ সাল রিয়েল এস্টেটের জন্য একটি ভালো বছর হবে বলে আশা করছি। আমরা যেহেতু সব সময় গুণগত মান অক্ষুণ্ন রেখে সঠিক সময়ে ক্রেতাদের কাছে অ্যাপার্টমেন্ট হস্তান্তর করে থাকি, তাই জাতীয় বিভিন্ন ইস্যু আমাদের ব্যবসায় বড় কোনো প্রভাব ফেলে না। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে শেলটেক উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রেডি অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করেছে। আশা করছি, এই ধারা ২০১৯ সালেও বজায় থাকবে।

প্রথম আলো: রিহ্যাবের বিভিন্ন হিসাবে জিডিপিতে খাতভিত্তিক অবদানের ক্ষেত্রে আবাসন খাতের অবদান ১৫ শতাংশ বলে দাবি করা হয়। সরকারি হিসাবে এর পরিমাণ ৭ শতাংশের বেশি না। রিহ্যাব কি বাড়িয়ে বলে, না তাদের অবদান স্বীকৃত হয় না?

তৌফিক এম সেরাজ: জিডিপিতে অবদানের ক্ষেত্রে আবাসন খাত দুইভাবে অবদান রাখে—আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক। পরিসংখ্যানে আনুষ্ঠানিক খাতের অবদান যেভাবে হিসাব করা হয়, অনানুষ্ঠানিক খাতের হিসাব সেভাবে আসে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আবাসন খাতের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল পরিবহনের জন্য যে পরিবহনশ্রমিক কাজ করেন, তা জিডিপিতে সরাসরি অবদান রাখে, কিন্তু এটা রিয়েল এস্টেটের অবদান হিসেবে জিডিপিতে প্রতিফলন দেখতে পাওয়া কঠিন। অন্যদিকে, আবাসন খাতের সঙ্গে প্রায় ২৭০টি সংযোগশিল্প জড়িত, যেগুলো সরাসরি জিডিপিতে অবদান রাখে। প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিক এই খাতে শ্রম দিচ্ছেন। এসব সংযোগশিল্প এবং শ্রমিকের অবদান বিবেচনায় নিয়ে জিডিপিতে আবাসন খাতের মোট অবদান হিসাব করতে হবে। অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৭-এ জিডিপিতে শুধু রিয়েল এস্টেট সেক্টরের সরাসরি অবদান ৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর সঙ্গে পরোক্ষ অবদান বিবেচনা করলে জিডিপিতে আবাসন খাতের অবদান ১২ থেকে ১৪ শতাংশের কম হবে না বলে আমি মনে করি।

প্রথম আলো: আপনি একাধিকবার বলেছেন, আবাসন খাত সরকারের সুদৃষ্টিবঞ্চিত সব সময়। কীভাবে এ বঞ্চনা করা হয়েছে?

তৌফিক এম সেরাজ: আবাসন খাত দেশের জিডিপিতে অবদান রাখার ক্ষেত্রে অন্যতম। তাই আমরা সব সময়ই এখানে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেছি। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে সরাসরি কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আবাসন খাতকে একটি শিল্প বলা হলেও শিল্প হিসেবে সরকারের সুদৃষ্টি এখানে লক্ষ করা যায়নি। একটি শিল্প যেসব সুবিধা পায়, তা থেকে আবাসনশিল্প অনেক ক্ষেত্রেই বঞ্চিত। দীর্ঘদিন ধরে আমরা আবাসন খাতের জন্য বিশেষায়িত ব্যাংক, আবাসন ঋণের জন্য বিশেষ তহবিলের কথা বলছি। কিন্তু আমরা এসব ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ দেখতে পাইনি। বরং আমরা দেখেছি, ২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা আবাসন খাতকে অনুৎপাদনশীল খাত হিসেবে উল্লেখ করেন। এ ধরনের মন্তব্যে বিনিয়োগকারীরা এই খাতের ওপর আস্থা হারান এবং নতুন বিনিয়োগের প্রতি আগ্রহ নষ্ট হয়।

প্রথম আলো: আবাসন খাত সরকারের কাছ থেকে কী ধরনের সহযোগিতা প্রত্যাশা করে?

তৌফিক এম সেরাজ: সরকারের কাছ থেকে কিছু উদ্যোগের মাধ্যমে আবাসন খাতকে মানুষের আরও কাছে নিয়ে গেলে এই খাত সরবরাহ আরও বাড়াতে পারবে। বর্তমানে জমি রেজিস্ট্রেশনের জন্য আয়কর, ভ্যাট এবং অন্যান্য শুল্ক মিলে প্রায় ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ খরচ পড়ে। এই অতিরিক্ত খরচ অনেক ক্ষেত্রেই ক্রেতাসাধারণের ওপর অতিরিক্ত বোঝা হিসেবে দেখা দেয়। এই খরচ কমিয়ে একটি সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসতে হবে। গৃহঋণে সুদের হার এখনো কিছু কিছু ক্ষেত্রে ১০ শতাংশের বেশি। প্রাথমিকভাবে এই সুদের হার কমিয়ে ৮ থেকে ৯ শতাংশে নিয়ে আসা প্রয়োজন। দীর্ঘ মেয়াদে এই সুদের হার ৪ থেকে ৫ শতাংশে আনা প্রয়োজন। এর জন্য একটি বিশেষ তহবিল তৈরি করা যেতে পারে। বেসরকারি আবাসন খাতের সব অনুমোদন ও অন্যান্য প্রক্রিয়ার জন্য একটি এককেন্দ্রিক সেবার কথা আমরা বলি। এ জন্য আমি মনে করি, রিয়েল এস্টেট অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলে এই খাতে উদ্যোক্তাদের ভোগান্তি হ্রাস পাবে এবং সব প্রক্রিয়া আরও দ্রুততর হবে।

প্রথম আলো: আবাসন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতারণার খবর আমরা অনেক পাই। অনেকে অভিযোগ করেন, ন্যায্য দাবি হলেও রিহ্যাব ভোক্তার পক্ষে দাঁড়ায় না, দাঁড়ায় সদস্য প্রতিষ্ঠানের পক্ষে। আপনারা ক্ষমতাবান, সরকারি সুবিধাও আপনারা পেয়ে থাকেন। কী বলবেন?

তৌফিক এম সেরাজ: অ্যাপার্টমেন্ট কেনার ক্ষেত্রে শুধু অ্যাপার্টমেন্টর মূল্য বিবেচনা না করে আরও অনেক বিষয় বিবেচনায় আনা উচিত। প্রতিষ্ঠানের অতীত ইতিহাস, ক্রেতাসাধারণের সঙ্গে সুসম্পর্ক, পণ্যের মান ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে অ্যাপার্টমেন্ট কেনার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অ্যাপার্টমেন্ট কিনলে এ ধরনের ঘটনা এড়ানো সম্ভব হবে। এর সঙ্গে আবাসন খাতে পেশাদারি প্রতিষ্ঠান নিশ্চিত করতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান পেশাগতভাবে মানসম্মত অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করে থাকে, তাদের স্বীকৃতি দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা আমাদের নেই। ভালো প্রতিষ্ঠান তাদের মানসম্পন্ন কাজের স্বীকৃতি পেলে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও মানসম্পন্ন কাজ করার অনুপ্রেরণা পাবে।

প্রথম আলো: আবাসন খাতের ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণ করার জন্য কোনো বিশেষ সেল কি আপনাদের আছে? আপনাদের বলতে আপনার নিজের প্রতিষ্ঠান এবং রিহ্যাবকেও বোঝাচ্ছি।

তৌফিক এম সেরাজ: আবাসন খাতে দীর্ঘ ৩১ বছরের অভিজ্ঞতায় শেলটেক এখন ক্রেতাসাধারণের কাছে ক্রেতাবান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুপরিচিত। শেলটেকের সব বিভাগ স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ভোক্তাদের কাছে মানসম্পন্ন অ্যাপার্টমেন্ট সরবরাহ করে আসছে। তাই এ ধরনের কোনো বিশেষ সেল শেলটেকের প্রয়োজন হয়নি। দীর্ঘ ৩১ বছরে ১৬৩টি প্রকল্পে ৩ হাজার ৭০০-এর অধিক অ্যাপার্টমেন্ট সঠিক সময়ে ও গুণগতমানে ক্রেতাসাধারণের কাছে সরবরাহ করেছি। এসব অ্যাপার্টমেন্টর অধিবাসীদের কাছে শেলটেক আস্থার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আমাদের দীর্ঘদিনের সুপরিচিত ক্রেতাসাধারণ নিজেরা আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট কেনার পাশাপাশি আত্মীয় ও বন্ধুদেরও আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট কেনার জন্য উৎসাহিত করেছেন, তাই আমাদের ক্রেতাসাধারণের মাধ্যমে আমাদের প্রচুর অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি হচ্ছে।

প্রথম আলো: শহরের, বিশেষ করে ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত বা ধনীদের গণ্ডি পেরিয়ে আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে বা অপেক্ষাকৃত কম আয়ের মানুষের দিকে কতটা গেছে? এ নিয়ে পরিকল্পনা আপনার নিজের প্রতিষ্ঠানের বা রিহ্যাবের আছে কি না?

তৌফিক এম সেরাজ: ঢাকা শহরের বাইরে এখনো অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করার সংস্কৃতি তৈরি হয়নি। এ ধরনের সংস্কৃতি তৈরি করার জন্য যে ধরনের অবকাঠামো ও পরিষেবা প্রয়োজন, তা এখনো নিশ্চিত করা হয়নি এবং সে লক্ষ্যে উদ্যোগও কম। ঢাকা শহরের বাইরে বেসরকারি আবাসন খাতকে জনপ্রিয় করতে হলে এসব সুযোগ-সুবিধা সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে।

প্রথম আলো: বাংলাদেশের নগরায়ণকে হঠাৎ নগরায়ণ বলে চিহ্নিত করা হয়। অর্থনীতি ও শিল্পায়নের প্রবৃদ্ধির গতির চেয়েও নগরায়ণ বেশি হচ্ছে। অর্থাৎ বেশি হারে মানুষ শহরবাসী হচ্ছে। এই ব্যাপক নগরায়ণে তাল মেলাতে আপনারা কতটা প্রস্তুত?

তৌফিক এম সেরাজ: নগরায়ণের সঙ্গে আবাসন সরাসরি সম্পৃক্ত। নগরায়ণ দ্রুত বৃদ্ধি পেলে আবাসনের চাহিদাও দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। আবাসন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবাসন সরবরাহ করতে আমরা সর্বদা প্রস্তুত। শেলটেক সর্বদাই মানুষের কাছে সীমিত দামে অ্যাপার্টমেন্ট সরবরাহ করার লক্ষ্যে সেসব জায়গায় প্রকল্প নিয়ে থাকে, যেখানে বর্তমানে জমির দাম কম, কিন্তু অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে অচিরেই দাম বাড়বে। তেমন একটি প্রকল্পের উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আমাদের শেলটেক বীথিকা প্রকল্পের কথা। সম্পূর্ণ রেডি এ অ্যাপার্টমেন্টের সংযোগ সড়কে মেট্রোরেলের পরিকল্পনা রয়েছে, যা সারা ঢাকা শহরের সঙ্গে আমাদের শেলটেক বীথিকা প্রকল্পকে সংযুক্ত করবে। এ ছাড়া তৈরি হবে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট, যার মাধ্যমে যানজটমুক্ত পথে বাসে চড়ে অধিবাসীরা শহরের দূর-দূরান্তে চলে যেতে পারবেন। আরও তৈরি হচ্ছে ঢাকা শহরের চারপাশে তিনটি বৃত্তাকার সড়কপথ, যেগুলো বর্তমান যোগাযোগব্যবস্থাকে উন্নততর করবে। আর এই বৃত্তাকার সড়কপথের প্রথমটির পাশেই আমাদের বীথিকা প্রকল্প। সদ্য সমাপ্ত এই প্রকল্পে কিছুসংখ্যক অ্যাপার্টমেন্ট এখনো অবিক্রীত আছে। এসব অ্যাপার্টমেন্টের ক্রেতারা অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে পরবর্তী সময় জমির মূল্য বৃদ্ধির পুরো সুবিধা ভোগ করবেন।

প্রথম আলো: সুষ্ঠু নগরায়ণের জন্য আপনার পরামর্শ কী?

তৌফিক এম সেরাজ: সুষ্ঠু নগরায়ণ নিশ্চিত করতে হলে ঢাকার ওপর চাপ কমাতে হবে। এ জন্য প্রশাসনিক ও নগরসুবিধাগুলোর বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ঢাকায় নগরায়ণ কমানো হলে এবং ঢাকা ছাড়া অন্যান্য নগরে নাগরিক পরিষেবা ও অবকাঠামোগত সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হলে নগরায়ণে ভারসাম্য আসবে।

প্রথম আলো: নগর-পরিকল্পনার ক্ষেত্রে আবাসন খাতের প্রতিনিধিদের কতটা সম্পৃক্ত করা হয় বা মতামত নেওয়া হয়?

তৌফিক এম সেরাজ: নগর-পরিকল্পনা সব সময় একটি অংশীদারি কাজ এবং এই প্রক্রিয়ায় সব অংশীজনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হলে তা অধিক কার্যকর হয়। নগর-পরিকল্পনার একটি বড় অংশ হচ্ছে নগরবাসীদের জন্য আবাসন সরবরাহ সুনিশ্চিত করা। বর্তমান ঢাকায় আবাসনের সবচেয়ে বড় সরবরাহ আসে রিয়েল এস্টেট থেকে। তাই নগর-পরিকল্পনা প্রক্রিয়ায় আবাসন খাতের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। কিন্তু আমাদের দেশে রাজধানী ঢাকার জন্য বিগত সময়ে ধাপে ধাপে যেসব পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেখানে আবাসন খাতের প্রতিনিধিদের মতামতকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়নি। আবাসন খাতের প্রতিনিধিদের মতামতের প্রতিফলন পরিকল্পনায় থাকলে এসব পরিকল্পনা আরও কার্যকর হবে বলে মনে করি।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

তৌফিক এম সেরাজ: আপনাকেও ধন্যবাদ।