'ঘটনাটি ব্যাংকিং খাতের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক প্রবণতা'

অধ্যাপক মইনুল ইসলাম
অধ্যাপক মইনুল ইসলাম

প্রথম আলো: ঋণ আদায়ে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের হত্যাচেষ্টার হুমকি ও নির্যাতনের যে ঘটনা ঘটেছে, তা কীভাবে দেখছেন?

মইনুল ইসলাম: ব্যাংকের ওপর বড় বড় শিল্প গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ কোন পর্যায়ে চলে গেছে, এ ঘটনা থেকে তা বোঝা যায়। ঋণ না পেলে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা যে কতখানি শিল্প গ্রুপের জবরদস্তির অধীনেও চলে যেতে পারেন, এ ঘটনা থেকে তাও প্রমাণ হয়। এ ধরনের ঘটনার মাধ্যমে ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার যে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, তা প্রচণ্ডভাবে বিপদের মুখে পড়েছে। এই ঘটনা ব্যাংকিং খাতের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক প্রবণতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

প্রথম আলো: আমরা তো জানি, ব্যাংক ঋণ দিতে চায়। সেখানে কেন জবরদস্তি ঘটনা ঘটবে?

মইনুল ইসলাম: ৫০০ কোটি টাকা ঋণের জন্য যে নিরাপত্তা জামানত দিতে চেয়েছে শিল্প গ্রুপটি, ব্যাংকের হিসাবে তার মূল্য অনেক কম। এই কারণেই তো জবরদস্তির ঘটনা ঘটেছে। এটা ঠিক, এ ধরনের জামানতের বিপরীতে যদি ঋণ দেওয়া হতো, তাহলে তা ফেরত আসত না। এই ঋণ তো ব্যাংক ফেরত পাবে না। যে জামানত দিচ্ছে, তা দিয়ে ব্যাংকের আসলের বড় অংশই ফেরত আসত না। ঋণ না দিয়ে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা সঠিক কাজ করেছেন।

প্রথম আলো: কোন প্রেক্ষাপটে এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর সাহস তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন?

মইনুল ইসলাম: বাংলাদেশের শাসনক্ষমতা ঋণখেলাপিদের হাতে চলে গেছে। ঋণখেলাপিদের খেলাপি আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে আগে থেকেই। এটা বুঝতে হবে, ২ শতাংশ এককালীন কিস্তি দিয়ে ঋণ পুনঃ তফশিল করার যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা ছিল মূলত ঋণখেলাপিদের ঋণ আড়াল করার চেষ্টা। এটা ছিল বিপজ্জনক পদক্ষেপ। এর ফলে যেটা ঘটবে তা হলো, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে খেলাপি ঋণের যে হিসাব প্রকাশিত হবে, তার বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে না।

কারণ বড় খেলাপিরা তাঁদের ঋণ আড়াল করে ফেলবেন ২ শতাংশ দিয়ে। এর ফলে খেলাপি ঋণ যেমন আদায় হবে না, তেমনি খেলাপি ঋণ মোট হিসাবেও থাকবে না। এটা আমি মনে করি, ক্ষমতাসীন দল এই সিদ্ধান্ত নিয়ে জাতিকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করছে। এ রকম পদক্ষেপের কারণে বড় বড় শিল্প গ্রুপের অনেকে বিদেশে পুঁজি পাচার করছে। জোর করে ঋণ আদায়ের মতো ঘটনা ঘটানোর সাহস পেয়েছে। কারণ, তারা জানে একবার টাকা বের করতে পারলে তা ফেরত না দিয়েও পার পাওয়া যাবে। এ ধরনের প্রবণতা ব্যাংকিং খাতের জন্য সামনে ভয়াবহ পরিস্থিতি ডেকে আনবে।

প্রথম আলো: এ ধরনের ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সরকারের কী ভূমিকা দেখতে চান? কী করা উচিত বলে মনে করেন?

মইনুল ইসলাম: এটা আসলে ফৌজদারি অপরাধ হয়ে গেছে। এখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেয়ে সরকারের ভূমিকা বেশি নিতে হবে। এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে, সে জন্য সরকারকে কঠোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রথমত, শিল্প গ্রুপটি যদি ৫০০ কোটি টাকা বের করে নিতে পারত, তাহলে ব্যাংকটির স্থায়ী ক্ষত তৈরি হতো। সেটি ঠেকানোর চেষ্টা করেছেন ব্যাংকটির শীর্ষ নির্বাহীরা। এখন ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা যদি মালিকদের কাছ থেকে নিরাপত্তা না পান, তাহলে এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটতে থাকবেই। এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করি না। বরং ঋণখেলাপিদের সরকার যেভাবে তাদের বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে আশকারা দিয়ে চলেছে, এই ঘটনা সেখান থেকে উদ্ভব হয়েছে। অতএব আগে সেখানেই হাত দিতে হবে।

প্রথম আলো: করোনা মোকাবিলায় সরকার আর্থিক খাতে ঋণ প্রণোদনা দিচ্ছে। তা বাস্তবায়ন করবে ব্যাংকগুলো। এ ধরনের ঘটনায় তা বাস্তবায়নে কোনো প্রভাব পড়বে কি না?

মইনুল ইসলাম: ঋণ প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করতে হলে ব্যাংকের আমানতের প্রবাহ ঠিক থাকতে হবে। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে আমানতের প্রবাহ সামনে প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রবাসী আয় কমে যাবে। লাখ লাখ প্রবাসী বেকার হয়ে দেশে ফিরবেন। আমানতের ঘাটতি হলে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার ক্ষমতাও কমে যাবে। পুঁজি পাচার তো বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে গেছে। এ অবস্থায় বড় গ্রুপগুলো জবরদস্তির মাধ্যমে ঋণ নেওয়ার পাঁয়তারা করছে, তা ঠেকানো না গেলে সামনে ব্যাংকিং খাতের অস্তিত্বই সংকটে পড়বে। স্বাভাবিকভাবেই ঋণ প্যাকেজ বাস্তবায়নও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।