খেলাপি ঋণ আদায়ে হচ্ছে সংস্থা

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও করপোরেশন নিয়ে যখন জনমনে হাজারো প্রশ্ন, তখন নতুন আরেকটি সংস্থা গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এবার সেই সংস্থা গঠন করা হচ্ছে খেলাপি ঋণ আদায়ে। সরকারি প্রতিনিধি থাকার পরও রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক থেকে যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে, সেখানে নতুন সংস্থার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কতটা আদায় করা যাবে, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার আন্তরিক হলে বিদ্যমান আইনেই ঋণখেলাপিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় এনে খেলাপি ঋণ উদ্ধার করা সম্ভব। সেটি না করে সরকার বরং খেলাপিদের নানা সুবিধা দিয়েছে বারবার। এ যখন অবস্থা, তখন সরকারি সংস্থা করে খেলাপি ঋণ আদায়ের উদ্যোগের সুফল মিলবে না; বরং সরকারের এই উদ্যোগ ব্যাংক খাতকে আরও নড়বড়ে করে দিতে পারে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই উদ্যোগ ব্যাংক খাতকে ডোবানোর আরেকটা ফন্দি। ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড এ ব্যাপারে সফল হয়েছে; কারণ, তাদের সরকার তুলনামূলক দক্ষ। আর পর্ষদের যে রূপরেখার কথা শুনলাম, তাদের পক্ষে টাকা আদায় করা অবাস্তব চিন্তা। ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রের আদলে বরং বেসরকারি পর্যায়ে খেলাপি ঋণ আদায়ের পরীক্ষামূলক উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। খেলাপি ঋণ আদায়ে সরকারি যে করপোরেশন বা সংস্থা করা হচ্ছে, সেটি পরিচালিত হবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে; যার নাম ঠিক করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশন’ (বামকো)। সংস্থাটির মূল কাজ হবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি বা জামানতি ঋণ আদায় ও কেনাবেচা করা।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সংস্থাটির পরিশোধিত মূলধন হবে ৩ হাজার কোটি টাকা আর অনুমোদিত মূলধন ৫ হাজার কোটি টাকা। ঋণগ্রহীতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সম্পদ অর্জন, ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ, খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনা ও আদায়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শ দেওয়ার কাজও করবে এই সংস্থা। আবার ঋণগ্রহীতা কোনো প্রতিষ্ঠান রুগ্ণ হয়ে গেলে পাশে দাঁড়াবে এবং কোনো প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হলেও এর সঙ্গে জড়িত সম্পত্তির ‘সরকারি রিসিভার’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। নতুন সংস্থাটি করার জন্য ‘বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশন আইন, ২০২০’ নামে আইনের খসড়া তৈরি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।

এর আগে সরকার করপোরেশনের বদলে সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানি করতে চেয়েছিল। কিন্তু আইএমএফের একটি মিশন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলামের সঙ্গে ছয় মাস আগে বৈঠক করে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠনের বিরোধিতা করেছে। আইএমএফ মিশনটি বলেছে, এ ধরনের উদ্যোগ বিশ্বের যেসব দেশ নিয়েছে, বেশির ভাগই সফল হয়নি; বরং বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। এরপরই কোম্পানি গঠনের চিন্তা থেকে সরে এসে সংস্থা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে সংস্থার অধীনে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠনের সুযোগ থাকবে বলে আইনের খসড়ায় উল্লেখ করা হয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলাম এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে যুগ্ম সচিব মু. শুকুর আলী বলেন, ইউরোপের অনেক দেশের পাশাপাশি ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভারত এ ধরনের উদ্যোগ নিয়ে সফল হয়েছে।

পর্ষদ হবে ১৫ সদস্যের

আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, একজন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে গঠিত হবে বামকোর ১৫ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ। কমপক্ষে ২৫ বছরের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা থাকা কোনো ব্যক্তিকে দেওয়া হবে বামকোর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব। তাঁর পদমর্যাদা হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরের সমান। বাকি ১৪ পরিচালক থাকবেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সরকারি সংস্থা, বাণিজ্য সংগঠন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। দেশি-বিদেশি যেকোনো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করতে পারবে এই সংস্থা। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স নেওয়া যেকোনো ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বামকোর আওতায় থাকবে। সংস্থাটির প্রধান কার্যালয় হবে ঢাকায়। তবে দেশের যেকোনো প্রান্তে ও বিদেশেও শাখা খুলতে পারবে। সংস্থাটি এক বা একাধিক সহযোগী কোম্পানিও গঠন করতে পারবে। কোনো ব্যাংক যে খেলাপি ঋণগুলো আদায়ে ব্যর্থ হবে, সেগুলো চুক্তির মাধ্যমে বামকোকে হস্তান্তর করবে। বামকো সে ঋণ আদায়ে ব্যবস্থা নেবে এবং আদায় হলে তার একটা অংশ পাবে। বামকো যদি মনে করে, ঋণখেলাপিতে পরিণত হওয়া প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন করে তা আবার সচল করা সম্ভব, তাহলে তা–ই করবে। ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পত্তি বিক্রির ক্ষমতাও থাকবে এই সংস্থার। আবার ম্যাজিস্ট্রেটের সাহায্য নিয়ে ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান দখলেও নিতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। ২০০৮ সালের শেষে তা ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০০৮ সালের তুলনায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫ গুণের বেশি। নতুন সংস্থা হলে খেলাপি ঋণের বর্তমান মামলাগুলোর কী হবে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে যুগ্ম সচিব শুকুর আলী বলেন, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পর্ষদ এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।