করদাতার সংখ্যা বাড়ানোর দিকে জোর দিতে হবে

ড. এ কে এনামুল হক
ড. এ কে এনামুল হক

বাজেট সামনে রেখে রাজস্ব আদায় ও সরকারের অগ্রাধিকার খাতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. এ কে এনামুল হক

প্রথম আলো: আগামী ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে প্রত্যক্ষ কর আদায়ে জোর দেওয়ার জন্য ইতিমধ্যেই সরকারকে অর্থনীিতিবদ ও বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন৷ এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
এনামুল হক: প্রত্যক্ষ করের ওপর জোর দেওয়ার পরামর্শ খুবই যৌক্তিক৷ তবে সরকার ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এ ক্ষেত্রে কতটা ও কীভাবে অগ্রসর হবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়৷ আমি মনে করি, এখন আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে করদাতার সংখ্যা বাড়ানো৷ কর আদায়ে টাকার অঙ্কের দিকেই সরকারের মনোযোগটা অনেক বেশি৷ কিন্তু টাকা তো আদায় হবে করদাতাদের কাছ থেকে৷ কাজেই করদাতার সংখ্যা বাড়াতে হবে৷ এ বিষয়ে রাজস্ব বোর্ডকে ৫ বা ১০ বছরের একটি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করতে হবে৷ বর্তমানে ১২ লাখ মানুষ আয়কর দেন৷ তিন কোটি পরিবারের এই দেশে এই সংখ্যা খুবই কম৷ আর বাংলাদেশের অর্থনীতি যেভাবে বিকশিত হচ্ছে, তাতে কোনোভাবেই এত অল্পসংখ্যক করদাতা নিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়া যাবে না৷ কাজেই এনবিআর এভাবেও চিন্তা করতে পারে যে আগামী ১০-১২ বছরে আয়করদাতার সংখ্যা ৮০ লাখে উন্নীত করবে৷ প্রতিবছর গড়ে সাত থেকে আট লাখ নতুন করদাতা যুক্ত করতে হবে৷ এটি করতে না পারলে বিদ্যমান করদাতাদের ওপর চাপই শুধু বাড়বে৷

প্রথম আলো: কিন্তু আয়করদাতার সংখ্যা শুধু বাড়িয়ে গেলে তা কতটা অর্থবহ হবে? ১২ লাখ মানুষ আয়কর দিলেও ১৮ লাখের বেশি মানুষের কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) আছে৷ তার মানে টিআইএনধারী এক-তৃতীয়াংশ আয়কর দেন না৷
এনামুল হক: আয়করদাতার সংখ্যা বাড়লে কর আদায়ের সুযোগ বেড়ে যাবে৷ আর কর ঠিকঠাকমতো আদায় করা এনবিআরের দায়িত্ব৷ এনবিআরকে এ জন্য নানা উপায় অবলম্বন করতে হবে৷ এ ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে করদাতাদের কিছু ছাড় বা রেয়াত দেওয়ার কথা ভাবা যেতে পারে৷ যেমন অগ্রিম আয়কর প্রদান উৎসাহিত করা৷ করের পরিমাণ যা-ই হোক না কেন, আগাম দিলে কিছু ছাড় মিলবে, এমন সুযোগ থাকলে নিয়মিত করদাতারা উৎসাহিত হবেন৷ কে কত কর দিলেন, সেটায় বেশি গুরুত্ব না দিয়ে এনবিআর যদি লক্ষ্য নেয় যে যারা কর দিচ্ছেন না, তাঁদের ছাড়া হবে না, তাহলেই পরিস্থিতি অনেক পাল্টে যাবে৷ বর্তমানে একটা বড় সমস্যা হলো, যাঁরা আয়কর দিচ্ছেন, বিশেষত যাঁরা বেশি আয়কর দিচ্ছেন, তাঁরা আরও দিচ্ছেন না কেন বা কতটা ফাঁকি দিচ্ছেন, সেটায় অনেক বেশি জোর দেওয়া৷ ধরেই নেওয়া হয়েছে যে যত ধনী, সে তত কর ফাঁকি দেন৷ কর ফাঁকি তো অবশ্যই হচ্ছে৷ কিন্তু এসব করদাতা তো করজালের আওতায় আছেন৷ যাঁরা করজালে নেই, তাঁদের করজালে আনা অিধক গুরুত্বপূর্ণ৷ আগামী কয়েক বছরের জন্য এ রকম একটা নীতি নিয়ে অগ্রসর হওয়া উচিত৷ মানুষজনের মধ্যে এ ধারণা তৈরি করা উচিত যে কর দিলে কোনো সমস্যা নেই, কর না দিলেই সমস্যা৷ তাহলে যাঁদের করযোগ্য আয় আছে, তাঁরা কর দিয়ে সমস্যামুক্ত থাকতে যেমন, এখন ব্যাংকের আমানতের সুদের ওপর উৎসে ১০ শতাংশ কর কাটা হয়৷ আর টিআইএন না থাকলে ১৫ শতাংশ৷ টিআইএনধারীদের জন্য এটা বছর শেষে সমন্বয়যোগ্য৷ এটাকে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে৷
প্রথম আলো: বাজেটে সরকারের অগ্রাধিকারমূলক কাজ হিসেবে কোন বিষয়গুলো আপনি চিহ্নিত করবেন?
এনামুল হক: বাজেটের মাধ্যমে এখন একটি সামাজিক নিরাপত্তা পরিকল্পনার (সোশ্যাল সিকিউরিটি প্ল্যান) দিকে অগ্রসর হওয়া৷ সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর (সোশ্যাল সেফটি নেট) মতো কর্মসূিচ তো আছেই৷ তবে সামাজিক নিরাপত্তা পরিকল্পনা হলো সমাজের সব চাকরিজীবীর জন্য এমন একটি নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা, যা অর্থনীতিতে কোনো বড় আঘাত এলে ও আয় হ্রাস পেলে এসব মানুষকে কিছুটা সুরক্ষা দেবে৷ এ জন্য সব চাকরিজীবীর জন্য একটি পেনশন কর্মসূচি প্রবর্তন করা উচিত৷ এটা প্রভিডেন্ট ফান্ডের মতোও হতে পারে৷ আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই দেশের বর্তমান দুই কোটি ২০ লাখ চাকরিজীবী একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অবসরে চলে যাবেন৷ তখন তাঁদের কী হবে? রাষ্ট্রকে তো এই চিন্তা করতে হবে৷ এ রকম একটি পেনশন-ব্যবস্থা থাকলে অবসর নেওয়ার পরও অবসরভোগী মানুষগুলোর জন্য নিয়মিত হাতে কিছু অর্থ আসবে আয় হিসেবে৷ আবার অর্থনীতিতে মন্দা বা বিপর্যয়ের নেতিবাচক প্রভাবে কাজ হারালে একটা ন্যূনতম সুরক্ষা থাকবে৷ কিছুদিন আগে অর্থমন্ত্রী সব বেসরকারি চাকরিজীবীর জন্য পেনশন কর্মসূচি করা হবে বলে জানিয়েছেন৷ সরকার যে শেষ পর্যন্ত চিন্তাভাবনা শুরু করছে, এটি ইতিবাচক৷ কেননা, এখন শুধু ১২ লাখ সরকারি চাকরিজীবী পেনশনের সুবিধা পান৷
প্রথম আলো: বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া না-দেওয়া নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে৷ অর্থমন্ত্রী এফবিসিসিআইয়ের পরামর্শক সভায় বলেছেন যে এই সুযোগ দেওয়া হবে না৷ আপনি কীভাবে দেখছেন?
এনামুল হক: যেকোনো কারণেই কেউ আগে তাঁর আয়ের কিছু অংশ প্রদর্শন করেনিন, এখন করতে চাইছেন৷ এটাকেই কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া বলা হচ্ছে৷ আমি মনে করি, এ নিয়ে আমরা অযথা বেশি তর্ক-বিতর্ক করছি৷ এনবিআরের উচিত নির্ধারিত কর নিয়ে এ ধরনের আয় প্রদর্শনের সুযোগ করে দেওয়া৷ কোনো প্রশ্ন করার দরকার নেই৷ বড়জোর কিছু জরিমানা আরোপ করা যেতে পারে৷ আর চেষ্টা থাকা উচিত, এই অর্থ যেন ব্যাংকব্যবস্থায় গচ্ছিত হয়৷ কেননা, ব্যাংকে টাকা রাখলেই তো তা সাদা হলো৷ এটা তো আর লুকানো থাকছে না৷ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ার যে কথা বলা হয়, সেটিরও সমস্যা আছে৷ এভাবে আসলে বিনিয়োগ হয় না৷
[সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আসজাদুল কিবরিয়া]