নিম্নতম মজুরিতে অসন্তুষ্ট করাতকল-শ্রমিকেরা

নিম্নতম মজুরিতে অসন্তুষ্ট করাতকল–শ্রমিকেরা
নিম্নতম মজুরিতে অসন্তুষ্ট করাতকল–শ্রমিকেরা

কাঠের দরকার হলেই করাতকল বা স মিলের খোঁজ পড়ে। প্রয়োজনীয় এ পণ্যের ব্যবসা দেশজুড়ে অনিয়ন্ত্রিতভাবেই গড়ে উঠেছে। এর বড় অংশই আবার অবৈধ৷ আর দেশের বনাঞ্চল ধ্বংস করার পেছনে এ অবৈধ করাতকল ব্যবসায়ীদের একটা ভূমিকা আছে৷
এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে শক্ত উদ্যোগ দেখা না গেলেও করাতকল–শ্রমিকদের মজুরি একটি কাঠামোর মধ্যে আনার প্রক্রিয়া চলছে। ইতিমধ্যে নিম্নতম মজুরি বোর্ড করাতকল-শ্রমিকদের ন্যূনতম ছয় হাজার ৪০০ টাকাসহ নতুন একটি মজুরিকাঠামোর সুপারিশ তৈরি করে শ্রম মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে।
শ্রমিকনেতারা সরকারের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও বোর্ডের সুপারিশে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলছেন, এ মজুরি দিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
গত ২৯ এপ্রিল করাতকল–শিল্পের শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি হারের খসড়া সুপারিশের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়৷ এতে বলা হয়, শ্রমিকদের জীবনযাপনের ব্যয় ও মান, উৎপাদন খরচ, উৎপাদনশীলতা, উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্য, কাজের ধরন, ঝুঁকি ও মান, মূল্যস্ফীতি, ব্যবসায়িক সামর্থ্য, দেশের এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনা নিয়ে সুপারিশ করা হয়েছে৷
২০১৩ সালের ৪ মার্চ করাতকল–শিল্প শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণে বোর্ডকে নির্দেশ দেয় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়৷ চেয়ারম্যান শহীদুল্লাহ বকাউলের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের বোর্ড একািধক বৈঠক এবং ঢাকা ও সিলেটের কয়েকটি করাতকল পরিদর্শন শেষে খসড়া সুপারিশ প্রণয়ন করে৷
সুপারিশ অনুযায়ী করাতকল-শ্রমিকেরা মূল মজুরির পাশাপাশি বাড়িভাড়া (মূল মজুরির ৩০ শতাংশ), ৬০০ টাকা যাতায়াত ভাড়া ও ৬০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পাবেন। তবে শিক্ষানবিশ শ্রমিকের মজুরি সব মিলিয়ে হবে চার হাজার ৫০০ টাকা।
মিস্ত্রি ও অপারেটর পদের দক্ষ শ্রমিকদের (গ্রেড-১) দৈনিক মজুরি ৪২০ টাকা। এই শ্রমিকদের মাসিক মূল মজুরি সাত হাজার ৫০০ টাকা। আর বািড়ভাড়া, যাতায়াত ও চিকিৎসা ভাতা যোগ করে তাঁদের মোট মজুরি হবে ১০ হাজার ৯৫০ টাকা। সহকারী মিস্ত্রি ও অপারেটরদের (গ্রেড-২) দৈনিক মজুরি ৩৪৫ টাকা। মাসিক মূল মজুরি ছয় হাজার টাকা। তাঁদের মোট মজুরি হবে নয় হাজার টাকা।
এ ছাড়া পুলার (টানোয়া) শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ২৯৫ টাকা। গ্রেড-৩-এর এই শ্রমিকদের মূল মজুরি পাঁচ হাজার টাকা ও মোট মাসিক মজুরি দাঁড়াবে সাত হাজার ৭০০ টাকা। এ ছাড়া হেলপার ও অন্য শ্রমিকদের (গ্রেড-৪) ২৪৫ টাকা দৈনিক ও মাসিক মূল মজুরি চার হাজার টাকা। তাঁদের মাসিক মোট মজুরি ছয় হাজার ৪০০ টাকা।
অবশ্য শ্রমিকপক্ষ থেকে দাবি ছিল, হেলপার ও অন্য শ্রমিকদের জন্য মাসিক মজুরি ১৩ হাজার ৭০০, সিনিয়র হেলপার বা টানোয়াদের জন্য ১৬ হাজার ৯০০, সহকারী মিস্ত্রি ও অপারেটরদের জন্য ২১ হাজার ৭০০ এবং মিস্ত্রি ও অপারেটরদের জন্য ২৬ হাজার ৫০০ টাকা। এর মধ্যে মূল মজুরির ৬০ শতাংশ বাড়িভাড়া, যাতায়াত এক হাজার ও চিকিৎসা ভাতা দেড় হাজার টাকা যুক্ত আছে৷
শেষ পর্যন্ত দাবির প্রতিফলন না হওয়ায় বোর্ডের খসড়া সুপারিশে ছয় সদেস্যর মধ্যে শ্রমিকপক্ষের দুই সদস্য স্বাক্ষরদানে বিরত থাকেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করে ঢাকা করাত কল শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ও মজুরি বোর্ডের শ্রমিকপক্ষের সদস্য আলী আকবর হাওলাদার বলেন, ‘এখনই হেলপাররা পাঁচ-ছয় হাজার টাকা মূল বেতন পান। তাই সুপারিশকৃত মজুরি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছি। দাবি না মানলে আন্দোলনে যাব।’
স্বাক্ষরদানে বিরত থাকা প্রসঙ্গে মজুরি বোর্ডে শ্রমিকপক্ষের স্থায়ী সদস্য ফজলুল হক বলেন, ‘মজুরি বোর্ড যা সুপারিশ করেছে, বর্তমান বাস্তবতায় তা দিয়ে জীবন চালানো অমূলক।’
এদিকে সুপারিশকৃত মজুরি কম বলে প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেন কারওয়ান বাজারের এবি টিম্বার ও করাতকলের স্বত্বাধিকারী আমির হোসেন। তিনি বলেন, ‘শ্রমিক-কর্মচারী কিছু সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন।’ সেগুলো কী, তা অবশ্য জানাতে চাননি তিনি।
শহীদুল্লাহ বকাউল বলেন, ‘সুপারিশটি চূড়ান্ত নয়। কারও কোনো আপত্তি থাকলে তা জানালে আবারও বৈঠক হবে। চূড়ান্ত করার আগে অবশ্যই তা বিবেচনা করবে শ্রম মন্ত্রণালয়।’
এদিকে কর্মচারীদের জন্য বোর্ডের সুপারিশ, শ্রমিকদের মতোই তাঁদের জন্য মূল মজুরি, মজুরির ৩০ শতাংশ বাড়িভাড়া এবং ৬০০ টাকা করে চিকিৎসা ভাতা ও যাতায়াত ভাতার সুপারিশ করা হয়েছে।
হিসাবরক্ষক, স্টোরকিপার, টাইমকিপার, টাইপিস্ট ও ক্লার্ক পদের কর্মচারীদের (গ্রেড-১) মূল মজুরি ছয় হাজার টাকা। মাসিক মোট নয় হাজার টাকা। সহকারী হিসাবরক্ষক, স্টোর অ্যাসিস্ট্যান্ট, টেলিফোন অপারেটর, বিক্রয়কর্মী, ড্রাইভার ও ক্যাশিয়ারদের পদের (গ্রেড-২) কর্মচারীদের মূল মজুরি পাঁচ হাজার ও সর্বমোট সাত হাজার ৭০০ টাকা।
এ ছাড়া গ্রেড-৩ অনুযায়ী পিয়ন, দারোয়ান, মালি, নাইটগার্ড ও সুইপারদের মূল মজুরি চার হাজার টাকা। তাঁদের মাসিক মোট মজুরি ছয় হাজার ৪০০ টাকা। এ ছাড়া শিক্ষানবিশকালে একজন কর্মচারী পাবেন চার হাজার ৫০০ টাকা।
খসড়া সুপারিশ মোটেই ‘সুবিবেচনা’ নয় বলে মনে করেন ঢাকা করাতকল শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি আবদুল মান্নান। তিনি বলেন, ‘বাড়িভাড়া, ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ ও খাওয়াদাওয়া মিলিয়ে এ যুগে ১০-১১ হাজার টাকায় চলা সম্ভব কি না, আপনিই বলুন।’
২০০৮ সালে মজুরি বোর্ড প্রথেম করাতকল-শ্রমিকদের জন্য মজুরিকাঠামো ঘোষণা করে। এতে শ্রমিকদের জন্য নিম্নতম মজুরি চার হাজার ১২০ টাকা ও কর্মচারীদের জন্য চার হাজার ২৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। তবে মালিকপক্ষ এ মজুরিকাঠামোর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করলে শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি বলে শ্রমিকনেতারা জানান।
অনিয়ন্ত্রিত করাতকল–শিল্প: সারা দেশে কত করাতকল আছে, তার কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। ঢাকা ও আশপাশের মিলিয়ে ৫৫০ করাতকল–শ্রমিকেরা ঢাকা করাত কল শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য। এ ছাড়া দেশে ২৫ হাজার করাতকল রয়েছে বলে শ্রম মন্ত্রণালয়ের অনুমান। একেকটি করাতকলে শ্রমিক-কর্মচারী রয়েছেন ৮-১০ জন। সে হিসাবে কর্মরত আছেন দুই লাখ ৫০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী৷
তবে বাংলাদেশ টিম্বার মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন বাহাদুর দাবি করেন, কয়েক লাখ করাতকল আছে। এর বেশির ভাগই কোনো নিয়মনীতি ছাড়াই এমনকি লাইসেন্স না নিয়ে শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ‘ম্যানেজ’ করে ব্যবসা করছে।
একাধিক ব্যবসায়ী জানান, করাতকলের ব্যবসায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে আইনের সঠিক প্রয়োগ প্রয়োজন। না হলে অসাধু ব্যবসায়ীরা দেশের বনাঞ্চল ধ্বংসের শেষ মাথায় নিয়ে যাবেন বলে মন্তব্য করেন তাঁরা।